ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সংস্কারে পাশে থাকবে জাপান

সংস্কারে পাশে থাকবে জাপান

জুলাই বিপ্লবের মধ্যদিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সংস্কার কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কার উদ্যোগে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে জাপান। গতকাল শুক্রবার টোকিওতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে সংস্কারকে সমর্থন দেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা।

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সংস্কার, জনপ্রশাসন সংস্কার, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ বিচার বিভাগ সংস্কারের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এসব সংস্কারে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউয়ের পর পূর্ণ সমর্থন দিলো জাপান। পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জাতি-গঠন প্রচেষ্টা, সংস্কার উদ্যোগ এবং শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের প্রচেষ্টার প্রতি জাপানের পূর্ণ সমর্থনের কথা জানান।

এদিকে টোকিওর জেট্রো সদর দপ্তরে জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) এবং জাইকা যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনারে’ নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে জাপানের সর্বাত্মক সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আমি এখানে এসেছি আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে। আমরা বড় বিপদের মধ্যে আছি। আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশ ১৬ বছরের একটি ভূমিকম্প পার করেছে। সবকিছু ভেঙে পড়েছে। আমরা এখন টুকরো টুকরো করে গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।

জাপানকে বাংলাদেশের বন্ধু আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, একজন ভালো বন্ধু কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়ায় এবং জাপান সেই বন্ধু। আমাদের কাজ হলো অসম্ভবকে সম্ভব করা এবং আপনারা আমাদের সঙ্গী ও বন্ধু। এটি বাস্তবে রূপ দিন।

নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা একটি ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, আমরা ইতিহাসকে দেখাতে চাই যে, এটি সম্ভব হয়েছে, তা-ও নিখুঁতভাবে। অন্য একটি বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করুন, যাকে আমরা নতুন বাংলাদেশ বলি। তাই আমাদের কাজ হচ্ছে একসাথে সেই নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করা। আপনাদের সহযোগিতায় এটি বাস্তবায়নযোগ্য এবং আমরা ইতোমধ্যে তার ভিত্তি স্থাপন করেছি।

মাতারবাড়ীতে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সম্প্রতি জাপানের পেন্টা-ওশান কনস্ট্রাকশন এবং টিওএ করপোরেশনের সঙ্গে বাংলাদেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এমআইডিআই উদ্যোগের মূল ভিত্তি এ সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে সহায়তা করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। এজন্য জাপানকে ধন্যবাদ জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, এটি পিছিয়ে থাকা একটি দেশের অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। এটি কেবল অর্থ উপার্জনের বিষয় নয়। এটি মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার ব্যাপার।

সমুদ্র যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে লাখ লাখ মানুষের ‘দরজা’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের মানুষের সমুদ্রে যাতায়াতের পথ হতে পারে বাংলাদেশ। মাতারবাড়ি হচ্ছে বাকি বিশ্বের জন্য দরজা। আমরা তাদের জন্য এই দরজা খোলা রাখব।

সেমিনারে জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়ক পার্লামেন্টারি ভাইস মিনিস্টার তাকেউচি শিনজি বলেন, বাংলাদেশ হলো একটি কৌশলগত বিন্দু যা এশিয়াকে সংযুক্ত করে এবং এই অঞ্চলের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে জাপান দেশটির উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে। অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখতে চায় জাপান সরকার। জাপানি সরকার দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে, জাপানি কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহ দেন। জাপানি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করে টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের দ্বিপকক্ষীয় বাণিজ্য মূলত টেক্সটাইল শিল্পভিত্তিক উল্লেখ করে তিনি আরো বিস্তৃত খাতে বিনিয়োগ বৈচিত্র্য আনার আহ্বান জানান।

উভয় দেশ সবার জন্য শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং অভিন্ন সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক (এফওআইপি) এর প্রতি তাদের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্ব্যক্ত করেছে। উভয় পক্ষ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে এবং জাতিসংঘের সনদের মূলনীতিগুলো সমুন্নত রেখে, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহযোগিতা জোরদারে নজর দেওয়া হয়। এ প্রেক্ষাপটে, অর্থনৈতিক সংস্কার ও জলবায়ু পরিবর্তনের সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য উন্নয়ন নীতি ঋণ এবং জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনের ডুয়েল-গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের ঋণের জন্য নোট বিনিময় হচ্ছে।

বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন, বাংলাদেশকে ১০৬ কোটি ডলার ঋণ দেবে জাপান। বর্তমান বাজারদরে (১২২ টাকা প্রতি ডলার দাম ধরে) এর পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। জাপানের এই সহায়তার মধ্যে আছে বাজেট সহায়তা। আবার রেলপথ উন্নয়নের প্রকল্পের অর্থও আছে। কিছু অর্থ শিক্ষা খাতে অনুদান হিসেবেও আসবে। এই ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। শফিকুল আলম স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন, বাংলাদেশকে জাপান বাজেট সহায়তা, রেলপথ উন্নয়ন ও বৃত্তির জন্য মোট ১০৬ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার দেবে। চুক্তি অনুযায়ী, জাপান অর্থনৈতিক সংস্কার ও জলবায়ু সহনশীলতা বাড়াতে ৪১ কোটি ৮ লাখ ডলার দেবে। এ ছাড়া জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথকে দ্বৈত গেজ ডাবল লাইনে উন্নীত করতে ৬৪ কোটি ১০ লাখ ডলার খরচ করা হবে। বৃত্তি সহায়তা হিসেবে ৪২ লাখ ডলার অনুদান দেবে জাপান সরকার।

বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ: ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) সিস্টেম বাস্তবায়ন, প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন, ব্যাটারিচালিত সাইকেল তৈরির কারখানা স্থাপন, তথ্য সুরক্ষার জন্য পাইলট প্রকল্প চালু এবং বাংলাদেশ স্পেশাল ইকোনমিক জোন (বিএসইজেড)-এর সাথে জমির চুক্তি সম্পর্কিত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং সহযোগিতা স্মারক (এমওসিএস) স্বাক্ষরের বিষয়টি স্বাগত জানিয়েছে, যা বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে। জাপানের অফিসিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স (ওএসএ) এর আওতায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য ৫টি টহল নৌকা দ্রুত সরবরাহের প্রতিশ্রুতি। উভয় সরকার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি স্থানান্তর চুক্তির বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে এবং চুক্তিটি দ্রুত সম্পন্ন করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।

মানবসম্পদ উন্নয়ন: দক্ষ মানবসম্পদসহ জনগণ-থেকে-জনগণ পর্যায়ে বিনিময় বাড়ানো এবং দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার। বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন বৃত্তি প্রকল্পে জাপান সহায়তা করে আসছে। গতকাল জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ড. ইউনূস। অনুষ্ঠানে শতাধিক বাংলাদেশি যোগ দেন।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপান: প্রধানমন্ত্রী ইশিবা রাখাইন রাজ্য, মিয়ানমার থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেওয়ার জন্য এবং তাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। অধ্যাপক ইউনূস এই বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের, বিশেষ করে ভাসানচরের জন্য জাপানের মানবিক সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। জাপান এই ইস্যুতে তাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। উভয় পক্ষ এ বিষয়ে একমত হয়েছে যে, বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মিয়ানমারে নিরাপদ, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনই এ সংকটের চূড়ান্ত সমাধান এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। উভয় পক্ষ সংকট সমাধানে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে আন্তরিক সংলাপের গুরুত্ব স্বীকার করেছে।

ড. ইউনূসকে ডক্টরেট ডিগ্রি: সামাজিক উদ্ভাবন এবং বৈশ্বিক উন্নয়নে অবদান রাখায় জাপানের সোকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বর্তমান সভ্যতার কাঠামোর মধ্যে মানুষ টিকে থাকতে পারবে না, কারণ বিশ্বজুড়ে পরিবেশ ধ্বংস অব্যাহত আছে। তিনি তার ‘থ্রি জিরো থিওরি’ বা তিন শূন্য তত্ত্ব— শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ-এর কথা উল্লেখ করে বলেন, এখন সবাই কেবল তাদের মুনাফা সর্বাধিক করতে চাচ্ছে। বিশ্বের সম্পদের সিংহভাগ এখন খুব অল্প কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত, যাকে তিনি এক অভিশাপ হিসেবে উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গত, প্রধান উপদেষ্টা চার দিনের সফর শেষে আজ শনিবার সকালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে টোকিও ত্যাগ করবেন এবং সিঙ্গাপুর হয়ে রাতেই ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত