অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ প্রায় ১০ মাস অতিবাহিত হচ্ছে। এখনও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসা বিএনপি এখন অনেকটা হার্ডলাইনে অববস্থান নিয়েছে। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির সিনিয়র নেতাদের বক্তব্যেও তা ফুটে উঠেছে। শুধু তারেক রহমানই নয়, নির্বাচনের বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও। গত বুধবার তারুণ্যের সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান বলেছেন, ‘আমরা ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশের জনগণের সরাসরি ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি সরকার দ্রুত দেখতে চায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। আবারও আমরা বলতে চাই, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তারেক রহমান বলেন, ‘আমি বলতে চাই, আপনারা জনগণের কাছে যান। তাদের প্রত্যাশা জানার চেষ্টা করুন, তাদের প্রত্যাশা বোঝার চেষ্টা করুন, জনগণের মন জয় করুন।’ কারণ জনগণ বিএনপির সব রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস। এর পরপরই সমাবেশের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে স্লোগান ধরে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘দিল্লি নয়, পিন্ডি নয়, নয় অন্য কোনো দেশ- সবার আগে বাংলাদেশ।’
তারেক রহমানের বক্তব্যের একদিন পর গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াইয়ে জিয়াউর রহমান শাহাদাতবরণ করেছেন, সেই গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা আজও প্রতি পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খুব শিগগিরই বাংলাদেশকে আমরা গণতন্ত্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত দেখতে পাব। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, মনে রাখবেন সবার জন্য গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধানের যে রাজনীতি শহিদ জিয়া রেখে গেছেন, তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। আলোচনার জন্য বিএনপিকে আবারও আমন্ত্রণ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আগামীকাল ২ জুন সোমবার দ্বিতীয় দফার এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় এ কথা জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, সরকার একের পর এক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার আনুষ্ঠানিকতা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাতে বাস্তব কোনো অগ্রগতি নেই। আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। জনগণের আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে বাস্তব পদক্ষেপ প্রয়োজন, কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়। সংবিধান সংস্কার কমিশন যদি নিজেদের মতো করে সংবিধান পরিবর্তন করতে চায়, তবে সে বিষয়ে জাতিকে একমত হতে হবে উল্লেখ করে বিএনপির সিনিয়র এই নেতা বলেন, জোর করে চাপিয়ে দিলে সেটা গণতন্ত্র নয়, তা হবে আরেকটি বাকশাল। সালাহউদ্দিন আরো বলেন, আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিশ্বাস করি, মতের ভিন্নতা থাকবেই। আর ডিসেম্বরের পর নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে একটি যুক্তিও নেই। দেশের মানুষ চায় অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সংস্কার বা নির্বাচন নয়; ভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে সরকার। দলের সিনিয়র নেতারা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে টালবাহানা হচ্ছে। উপদেষ্টারা নির্বাচন নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলছেন। দলটির নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নিয়ে টালবাহানা করছে। নির্বাচনের কথা বললেই তারা সংস্কারের ইস্যু সামনে আনে। কিন্তু সংস্কারের প্রক্রিয়াও ধীরগতিতে এগোচ্ছে। একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কোন সংস্কারগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে করতে চায়, সরকার সেটিও বলছে না। সরকারের মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে, তারা থেকে যেতে চায়। সুতরাং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নির্বাচনের দাবিতে আমাদের আবার হয়তো মাঠে নামতে হতে পারে। মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে। তারা এও বলছেন, সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে সরকারের উচিত সংকট উত্তরণে দ্রুত সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়ে দেশকে নির্বাচনমুখী করা। তবে সরকার নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি করলে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে। দলটি মনে করে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ করে সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বাংলাদেশকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। গণতন্ত্রে উত্তরণের যখন একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তখন একটা কালো ছায়া এসে দাঁড়াচ্ছে। সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচন, জনগণকে তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। মির্জা ফখরুল বলেন, বিভাজনের রাজনীতি আবার শুরু হয়েছে। গোত্রে গোত্রে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের মধ্যে কিছু অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে, দেশকে অস্থিতিশীল করতে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরস্পরের মুখোমুখি করার একটা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। নেতাকর্মীদের সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সজাগ থাকতে হবে, সেইসঙ্গে রুখে দাঁড়াতে হবে, সমস্ত চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। তাই সঠিক সময়ে বর্তমান সরকারকে নির্বাচন দিতে হবে। তিনি বলেন, এই সরকার বলেছিল তারা জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেবে, সেটাই তাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। তাই সঠিক সময়ে বর্তমান সরকারকে নির্বাচন দিতে হবে।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের ‘এক ব্যক্তিই চান না’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, ‘খুব দুঃখের সঙ্গে বলছি, দেখলাম ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব (প্রধান উপদেষ্টা) জাপানে বসে বিএনপির বদনাম করছেন। একটু লজ্জাও লাগল না দেশের সম্পর্কে বিদেশে বসে বদনাম করতে। তিনি বললেন, একটি দল নির্বাচন চায়। আর আমরা বলতে চাই, একটি লোক নির্বাচন চায় না, সে হলো ড. ইউনূস। উনি নির্বাচন চায় না। মির্জা আব্বাস জোরালো কণ্ঠে বলেন, ‘বিএনপি বরাবরই নির্বাচন চেয়েছে ডিসেম্বরের মধ্যে এবং এই ডিসেম্বরের কথা কিন্তু ইউনূস সাহেব স্বয়ং বলেছেন। আমরা বলিনি... তারই প্রস্তাব। পরবর্তিতে তিনি শিফট করে চলে গেলেন জুন মাসে। জুন মাসে যদি নির্বাচনের কথা বলেন, এই নির্বাচন কখনও বাংলাদেশে হবে না। সুতরাং নির্বাচন যদি করতে হয় ডিসেম্বরের মধ্যেই করতে হবে।
বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সব রাজনৈতিক দলই চায় ডিসেম্বরে নির্বাচন হোক- এমন দাবি করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা কেন বিএনপিকে নির্বাচন নিয়ে দোষারোপ করলেন তা বোধগম্য নয়। পুরো জাতি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। এসময় ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ সরকার শিগগির দেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিএনপির এই নেতা।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে বলে মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে অবশ্যই হতে হবে। দেশে কেউ বিনিয়োগ করতে আসলে তারা জিজ্ঞেস করে নির্বাচন কবে। তারা একটি নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়। নির্বাচিত বিরোধীদল, নির্বাচিত সংসদ দেখতে চায়। তিনি আরও বলেন, যদি কেউ বলে শুধু একটি দল নির্বাচন চায়, এটা কী সত্য? এরইমধ্যে আমাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, এমন ৫২টা রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। এই রকম একটা বক্তব্য আমাদের জন্য বিব্রতকর, জাতি বিভ্রান্ত হচ্ছে। হাতেগোনা কয়েকটি দল নির্বাচন চায় না উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ৪ থেকে ৫টি দল, এরা কোনো নিবন্ধিত দলও না, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, তারা নির্বাচন চায় না। ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও এমন কিংস পার্টি হয়েছিল। কথাগুলো বলতে চাই না এই কারণে, এসব বললে জাতির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, জাপানে বসে প্রধান উপদেষ্টা যেভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে বিএনপি মানুষ চিনতে ভুল করেছে। তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছিল গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। এবার গণতন্ত্রের বিজয় আদায় করতে হবে।’
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে ‘সম্মানের সঙ্গে’ চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেছেন, সরকারকে আহ্বান করব- ছোট ছোট শিশুদের, সারা বাংলাদেশের মানুষের মনের ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন। ১০ মাস লাগে না এ সংস্কার করতে, নির্বাচন দিতে। অথচ আপনারা ১০ মাস অতিক্রান্ত করেছেন।
জয়নুল আবেদীন বলেন, আমাদের নেতা (তারেক রহমান) বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে। এর মধ্যে নির্বাচন দেওয়া খুব একটা বড় সমস্যা বলে মনে করি না। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে সম্মানের সঙ্গে চলে যাবেন। আমরা সবাই আপনাদের সহযোগিতা করব।
বাংলাদেশের সব মানুষ নির্বাচন চায়। নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুত। তাহলে সে প্রস্তুতি কাজে লাগানো হচ্ছে না কেন? সরকারের কাছে এই প্রশ্ন রেখেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তিনি আরও বলেন, আজকের সরকার কথায় কথায় সংস্কারের কথা বলে। ছোট সংস্কার, বড় সংস্কারের কথা বলে। এই সংস্কার শুরু করেছেন জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। তিনিই প্রথম ফারাক্কার চুক্তি নিয়ে জাতিসংঘে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। আন্তর্জাতিক নদী কমিশনের কাছে এটা উত্থাপন করেছিলেন। সংস্কার ছিল নিষিদ্ধ হওয়া রাজনৈতিক দলগুলোকে আবার রাজনীতির সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাল কেটে কৃষি খাতকে উন্নত করেছিলেন। বাংলাদেশকে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে প্রথম জনশক্তি রপ্তানি করেছিলেন তিনি।