আদালতের আদেশের তিন দিনের মাথায় জামায়াতে ইসলামীকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ফিরে দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফলে দীর্ঘ দিন দমন-পীড়নের শিকার হয়েও দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় শক্তি হিসেবে ফিরে আসছে। ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী এখন বড় ফ্যাক্ট বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রার আট দশকেরও অধিক সময় পার করেছে জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনও জোটে কখনও বা বিভিন্ন সংগঠনের আড়ালে মাঠে নেমে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে দলটি। তবে বরাবরই ছিল দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরের শক্তি। পেয়েছে ‘কিং মেকারের’ তকমাও। প্রথমবারের মতো এবারই জাতীয় রাজনীতিতে একক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। নিবন্ধন ফিরে পাওয়া এবং প্রতীক পাওয়ায় আসন্ন নির্বাচনেও ধর্মভিত্তিক দলটির প্রভাব জারি থাকবে।
গতকাল বুধবার কমিশন সভা শেষে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, নির্বাচন কমিশন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী দলীয় নিবন্ধন ও প্রতীক ফেরত পাবেন। তবে দলীয় প্রতীকটি ফেরতের ক্ষেত্রে দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষ করে সময় লাগবে।
উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করে আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ফেরত দেওয়া হবে। অর্থাৎ তারা দলীয় নিবন্ধন এবং দলীয় প্রতীক দুটিই ফেরত পাবেন। তিনি জানান, অতিসত্বর জামায়াতে ইসলামী তাদের নিবন্ধন ফেরত পাবে, সে ব্যবস্থা ইসি গ্রহণ করছে। তবে দলীয় প্রতীকের ক্ষেত্রে একটি দাপ্তরিক প্রক্রিয়া আছে, এ জন্য একটু সময় লাগবে।
এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, জামায়াতে ইসলামী তাদের দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা, সেটিও ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ইসির কাছে আবেদন করেছিল। ইসি বিশদভাবে আলোচনা করেছে। যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে ‘স্ট্যাটাসকো এনটে’ বলতে কী বোঝায়, অর্থাৎ ২০১৩ সালে জামায়াতের দলীয় নিবন্ধনের সঙ্গে প্রতীক ছিল, সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালের ৫ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন প্রজ্ঞাপনে নিবন্ধনের সঙ্গে দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা দেওয়া হয়েছিল একই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশ্লিষ্ট ধারাও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ২০১৬ সালে আদালতের একটি ফুল কোর্ট সভার সিদ্ধান্তের আলোকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাতিল করা হয়। এটি ছিল প্রশাসনিক পত্র, রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে তৎকালীন ইসি এটি পেয়েছিল। সেটির আলোকে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী ইসির কাছে যে আবেদন দিয়েছে, তার সঙ্গে একটি রিট পিটিশন এবং তার আদেশও ইসির সামনে এসেছে। দাঁড়িপাল্লা যাতে কোনো প্রতীক হতে না পারে, যেহেতু এটা ন্যায়বিচারের প্রতীক, এই মর্মে একটি আপিল করা হয়েছিল। সেই আপিল সে সময় আদালত খারিজ করে দেন এবং বলেন, এটি নির্বাচনে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করার কারণে কোনোভাবেই আদালতের মান ক্ষুণ্ণ করবে না। ইসির জানামতে এই রায় এখনো বহাল রয়েছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, কোর্টের যে আদেশ থাকবে তার প্রেক্ষিতে বিধিমালাতে এটা অন্তর্ভুক্ত করবে ইসি। বিধিমালায় যুক্ত করার পর খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে ইসি। ভেটিং শেষে আইন মন্ত্রণালয় থেকে ফেরত আসলেই গেজেট করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।
এরআগে, গত ১ জুন রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় আপিল বিভাগ। রায়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ বলেন- নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় ন্যায়সংগত ছিল না।
দীর্ঘ এক যুগ পর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরে পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন দলটির আইনজীবী ব্যারিস্টার শিশির মনির। তিনি বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলার অবসান ঘটল।
শিশির মনির বলেন, পলিটিক্যালি মোটিভেটেড পিআইএল-এর মাধ্যমে জামায়াতের নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আজকের রায়ের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও অংশগ্রহণমূলক সংসদের পথ সুগম হলো।
সংসদ গঠিত নিয়ে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, আমরা আশা করি, এই রায়ের পর একটি সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণবন্ত সংসদ গঠিত হবে, যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। আমরা প্রত্যাশা করি, আগামী সংসদ হবে প্রাণবন্ত বিতর্কে ভরপুর যা গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দেবে।
জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জানুয়ারি মাসে জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রিট আবেদন করেন তরীকত ফেডারেশন, জাকের পার্টি ও সম্মিলিত ইসলামী জোটের কয়েকজন নেতা। চার বছর পর ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে। পরে সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেও জামায়াত চেম্বার আদালতে তা খারিজ পায়।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। এরপর দলটি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ হারায়।
তবে জামায়াত সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে, শুনানিতে মূল আইনজীবী অনুপস্থিত থাকায় ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ আপিলটি খারিজ করে দেয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত পুনরুজ্জীবনের আবেদন করলে, ২০২৩ সালের ২৪ আগস্ট সর্বোচ্চ আদালত তা গ্রহণ করে।
এরপর শুনানি শেষে গত রোববার আপিল বিভাগ জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় খারিজ করে দেয়।
এর আগে, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ছাত্র আন্দোলনের সহিংসতার অভিযোগে জামায়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।