আদালতের আদেশের পর নিবন্ধিত দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর গেজেট প্রকাশ করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ঈদুল আজহার চলমান ছুটি শেষ হওয়ার পর প্রথম সপ্তাহে এ গেজেট প্রকাশ করবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। গেজেট প্রকাশ হলে ৫০ দল হিসেবে ইসির নিবন্ধন তালিকায় যুক্ত হবে দলটি। এর ফলে আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক ব্যবহার করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে দলটি।
ইসি কর্মকর্তা জানান, গত বুধবার (৪ জুন) জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। ঈদের ছুটির আগে শেষ কর্মদিবস ছিল ওই দিন। এজন্য নিবন্ধন গেজেট ওইদিন প্রকাশ করতে পারেনি। ছুটির পর যেদিন প্রথম অফিস খুলবে ওই দিনই নিবন্ধন গেজেট প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। তবে প্রতীক দিতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রার আট দশকেরও অধিক সময় পার করেছে জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনও জোটে কখনও বা বিভিন্ন সংগঠনের আড়ালে মাঠে নেমে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে দলটি। তবে বরাবরই ছিল দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরের শক্তি। পেয়েছে ‘কিং মেকারের’ তকমাও। প্রথমবারের মতো এবারই জাতীয় রাজনীতিতে একক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। নিবন্ধন ফিরে পাওয়া এবং প্রতীক পাওয়ায় আসন্ন নির্বাচনেও ধর্মভিত্তিক দলটির প্রভাব জারি থাকবে।
জামায়াতের নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আদালতের আদেশের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, প্রতীকের বিষয়টি আমরা বিবেচনায় নিয়ে নিয়েছি। একই প্রজ্ঞাপনে ২০০৮ সালে দলটিকে প্রতীকসহ নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতীক কোনো দলকে দিলে সেটি সেই দলের জন্য সংরক্ষিত থাকে আরপিও অনুযায়ী। দলটি প্রতীকসহ নিবন্ধন পাবে।
প্রতীকসহ দলের নিবন্ধন ফেরতের বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, গত ১ জুন মহামান্য আপিল বিভাগ ২০১৩ সালের হাইকোর্টের একটি রায়ের মাধ্যমে দলটির নিবন্ধন যে বাতিল করেছিল, সেটাকে পূর্বাপর অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। আদেশের কপি নির্বাচন কমিশনে পাঠাতে বলেছেন এবং ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। যে কারণে আমরা আলোচনা করেছি। অতিসত্বর জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন ফিরে পাবে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে আমাদের কাছে একটি আবেদন করেছে, তারা চান তাদের দাঁড়িপাল্লা যে দলীয় প্রতীকটি ছিল সেটিও যেন ফেরত পান। আমরা এটা নিয়েও বিশদ আলোচনা করেছি।
১৯৮৬ সাল থেকে নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছিল জামায়াত। ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের বিধান চালু করে। ২০০৮ সালে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকসহ নিবন্ধন পায় জামায়াতে ইসলামী। এরপর দলটির গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। এরপর ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন (বর্তমানে অবসর), বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (পরে আপিল বিভাগের বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন) ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের (১৯ নভেম্বর পদত্যাগ করেন) সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ।
সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। তবে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে আপিল করারও অনুমোদন দিয়ে দেন। এ রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ওই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে। তবে জামায়াতের আইনজীবীর অনুপস্থিত থাকায় ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে এক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে নির্বাচন কমিশনকে প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা বরাদ্দ না দিতে এবং কাউকে প্রতীক দিয়ে থাকলে তা বাতিল করতে চিঠি দেয়। নির্বাচন কমিশন সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে স্থানীয় নির্বাচন ও পরে ২০১৭ সালে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধন করে প্রতীকের তালিকা থেকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকটি বাদ দিয়ে দেয়। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটির নিবন্ধন সনদও বাতিল করে ইসি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর মাত্র কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগ সরকার অঙ্গ সংগঠনসহ জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে সরকার পতনের পর ২৮ অগাস্ট জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণার আগের নির্বাহী আদেশ বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।
এরপর ২০২৩ সালে খারিজ হওয়া আপিলটি পুনরুজ্জীবনের (রিস্টোর) জন্য আবেদন করে জামায়াত। গত ২২ অক্টোবর বিলম্ব মার্জনা করে আপিলটি শুনানির জন্য পুনরুজ্জীবনের আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এরপর কয়েক দফা শুনানি শেষে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ বাতিল করেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ আদেশে বলেন, দলটির ক্ষেত্রে পেন্ডিং (অনিষ্পন্ন) গঠনতন্ত্র ও রেজিস্ট্রেশন ইস্যু এবং অন্য কোনো ইস্যু যদি থেকে থাকে, তা সাংবিধানিক ম্যান্ডেট পুরোপুরি প্রয়োগ করে নিষ্পত্তি করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দেওয়া হলো।
আদালতের আদেশের বলেই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ দাবি করেন, ২০১৩ সালের হাইকোর্টের রায়ে পূর্বের যে অবস্থা ছিল সেই অবস্থাতেই থাকবে। ২০০৮ সালে যেমন আমি দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলাম, তেমনি এখনও আমরা প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা পাব। এরআগে, গত ১ জুন রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় আপিল বিভাগ। রায়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ বলেন- নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় ন্যায়সংগত ছিল না।
দীর্ঘ এক যুগ পর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরে পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন দলটির আইনজীবী ব্যারিস্টার শিশির মনির। তিনি বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে রাজনৈতিক উদ্দেশে দায়ের করা মামলার অবসান ঘটল।
শিশির মনির বলেন, পলিটিক্যালি মোটিভেটেড পিআইএল- এর মাধ্যমে জামায়াতের নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আজকের রায়ের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও অংশগ্রহণমূলক সংসদের পথ সুগম হলো।