আওয়ামী লীগ আমলের সাড়ে ১৫ বছরে দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরাতে ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন চেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাচার হওয়া বেশিরভাগ অর্থ বর্তমানে যুক্তরাজ্যে থাকায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ড. ইউনূসের অনুরোধে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সাড়া না দিলেও ব্রিটেনের মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ বাকিংহাম প্যালেসে ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেন। ‘কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণের আগেই দুজনের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের যে বড় রকমের ট্রানজিশন হচ্ছে, তা তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কী কী রি-ফর্মের (সংস্কার) পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেসব বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস কিং চালর্সকে অবহিত করেন বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘কিং চালর্স ড. ইউনূসকে অনেক দিন ধরে চেনেন। সেজন্য তাদের মধ্যে অনেক ধরনের আলোচনা হয়েছে। আধা ঘণ্টার এই বৈঠক খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। আমরা বলব, এই সফরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ছিল এটি।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমান সময়ে এই অ্যাওয়ার্ড দেশের জন্য একটি বড় স্বীকৃতি। প্রধান উপদেষ্টাকে এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হচ্ছে তার লাইফ লং (সারা জীবনের) কাজের স্বীকৃতি হিসেবে।’ এসব কাজের উদাহরণ হিসেবে ‘মাইক্রোক্রেডিটের (ক্ষুদ্র ঋণ)’ কথা তুলে ধরেন শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘মাইক্রোক্রেডিট সারা বিশ্বে দারিদ্র্য কমিয়ে আনার জন্য বড় ধরনের একটি টুল (মাধ্যম)। প্রধান উপদেষ্টা সোশ্যাল বিজনেস নিয়েও কাজ করেছেন। সোশ্যাল বিজনেস কীভাবে পৃথিবীর মানুষের দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে পারে, বিশ্বের অনেক ইস্যু আছে; যেগুলোতে প্রফিট ওরিয়েন্টেড কোম্পানি কাজ করতে পারে না, সেখানে সোশ্যাল বিজনেস কাজ করতে পারে। এছাড়াও তিনি ‘থ্রি-জিরো’ নিয়ে কাজ করেছেন। মানুষের জন্য প্রধান উপদেষ্টার সারা জীবনের যে ডেডিকেশন, মানুষের মঙ্গলের জন্য যে কাজগুলো তিনি করেছেন; কিং চার্লসের এই পুরস্কার সেসব কাজেরই স্বীকৃতি।’ প্রেস সচিব বলেন, কিং চার্লস একজন দরিদ্রবান্ধব কিং, পরিবেশ নিয়ে তিনি খুব ভালো ভালো কাজ করেছেন। ড. ইউনূস যত বই লিখেছেন, তার মধ্যে একটা বড় বইয়ের ফোরওয়ার্ড (মুখবন্ধ) লিখে দিয়েছিলেন কিং চার্লস। বইটি ব্লকবাস্টার ছিল।
এদিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে যুক্তরাজ্য সফর করছেন। সেখানে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে পাচার হওয়া কয়েক বিলিয়ন ডলার অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন চাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা। ড. ইউনূস ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, যুক্তরাজ্যের উচিত ‘নৈতিকভাবে’ তার সরকারকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ‘চুরি হওয়া’ অর্থ খুঁজে বের করতে সহায়তা করা। পাচার হওয়া এসব অর্থের বেশিরভাগই বর্তমানে যুক্তরাজ্যে রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী স্টারমার এখনও তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে তার সরাসরি কোনো কথা হয়নি। তবে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সমর্থন করবেন এ বিষয়ে তার ‘কোনো সন্দেহ নেই’ বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। পাচার হওয়া টাকার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা চুরি করা টাকা। এদিকে যুক্তরাজ্যের সরকারি কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, স্টারমারের ইউনূসের সঙ্গে দেখা করার কোনো পরিকল্পনা নেই। তারা এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্যও করতে চাননি। প্রধান উপদেষ্টার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য সরকার অর্থ খুঁজে বের করতে সহায়তা করছে। ড. ইউনূস বলেছেন, যুক্তরাজ্যের উচিত ‘আইনগত এবং... নৈতিকভাবে’ বাংলাদেশকে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বাধ্যবাধকতা অনুভব করা। তার যুক্তরাজ্য সফরের উদ্দেশ্য ছিল পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে দেশটির আরও বেশি জোরালো সমর্থন আদায় করা।
এদিকে গত বুধবার যুক্তরাজ্যের লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে পাচার হওয়া সম্পদ ফেরানোর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টা জোরদার করেছে বাংলাদেশ। শফিকুল আলম বলেন, ‘পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া। তাই এ কাজে গতি আনতেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রচেষ্টা আরও জোরদার করেছে।’
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে লন্ডনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর রয়েছেন। তিনি বলেন, পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত আনার বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এরইমধ্যে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির (এনসিএ) সঙ্গে বৈঠক করেছেন। শফিকুল আলম বলেন, পাচারের অর্থ শনাক্ত, কীভাবে পাচার হয়েছে, তা খুঁজে বের করা ও জব্দ করার বিষয়ে এনসিএর ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ বিষয়ে সংস্থাটি এরইমধ্যে দুটি পদক্ষেপও নিয়েছে। পাচার করা অর্থ কীভাবে ফেরত আনা যায়, তা জানতে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাও যাচাই করা হচ্ছে বলে জানান প্রেস সচিব। তিনি বলেন, এ লক্ষ্যেই একাধিক বৈঠক হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জনাথন পাওয়েলের সঙ্গেও এই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আলোচনা করেছেন বলে জানান শফিকুল আলম। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট, জাতীয় ঐকমত্য গঠনে বাংলাদেশের উদ্যোগ, দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক শান্তি-স্থিতিশীলতা নিয়েও তারা আলোচনা করেছেন।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত যুক্তরাজ্যে কিয়ার স্টারমারের দল লেবার পার্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার হুমকি তৈরি করেছে। দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্তের জেরে গত জানুয়ারিতে ব্রিটিশ ‘সিটি মিনিস্টারের’ পদ ছাড়তে বাধ্য হন টিউলিপ সিদ্দিক। স্টারমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত টিউলিপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে সম্পদ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিত্বদের কাছ থেকে সম্পত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবে টিউলিপ সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে সরে দাঁড়ান।