ইরানের সামরিক ও পরমাণু লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলি হামলার পর শক্ত জবাব দিচ্ছে ইরান। রাজধানী তেলআবিব ও অধিকৃত জেরুজালেমে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো। শুক্রবার দিনে ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রোন এবং সন্ধ্যায় মিসাইলের কয়েকটি ব্যারেজ নিক্ষেপ করেছিল ইরান। এরপর মধ্যরাতে এবং শনিবার সকালে পাঁচ দফায় কয়েকশ’ মিসাইল দিয়ে হামলা চালানো হয়। ইসরায়েলের হারেৎজ নিউজ জানিয়েছে, অন্তত দেড়শ’ স্থাপনায় ১৫০ মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়; এসময় ইসরায়েলজুড়ে সাইরেন বাজতে থাকে। হামলার আশঙ্কায় গত শুক্রবার পুরোদিনই ইসরায়েলের সড়কগুলোতে গাড়ি ও লোকজনের তেমন চলাচল ছিল না। সুনসান রাতে টানা সাইরেনের পর পুরো ইসরায়েলে অভূতপূর্ব ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। তেলআবিব শহরে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরের পাশে বড় আকারে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম চ্যানেল থার্টিন। ইসরায়েল হাওম নামের আরেকটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, মধ্য ইসরায়েলের সাতটি জায়গায় ইরান থেকে উড়ে আসা মিসাইল আঘাত হেনেছে।
হতাহত ৯৪, অসংখ্য ভবন বিধ্বস্ত : আলজাজিরায় প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে, তেলআবিবের ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে রিশোন লেজিওন ও তেলআবিবের পাশে রামাত গান এলাকার অসংখ্য ভবন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। আরও অনেক এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তিনজনের প্রাণহানি এবং ৯১ জন গুরুতর আহত হয়েছেন বলে ইসরায়েল স্বীকার করলেও আরও বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইরানের মেহের নিউজ জানিয়েছে, শুক্রবার ও শনিবাবারের সংঘাতে ইরান অন্তত তিনটি ইসরায়েলি এফ-থার্টিফাইভ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে এবং এর পাইলটদের আটক করেছে, যাদের মধ্যে একজন নারীও আছেন। ইরানের আকাশসীমায় এগুলোকে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। ইরানের অফিসিয়াল টুইটার পেইজে ভূপাতিত যুদ্ধবিমানগুলোর ছবি দেওয়া হয়।
বাঙ্কারে নেতানিয়াহু, আশ্রয়কেন্দ্রে লাখ লাখ ইসরায়েলি : ইরানি হামলার পর ইসরায়েলের অনেক শহর এখন ভুতুড়ে। এ অবস্থায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ জনসাধারণকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার নির্দেশ দিয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। রয়টার্স জানিয়েছে, নির্দেশনার কয়েক মিনিট পর থেকে তেলআবিব ও জেরুজালেমে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। রয়টার্স প্রচারিত ভিডিওতে দেখা গেছে, তেলআবিবে মিসাইল আছড়ে পড়ার পর ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হচ্ছে। ইরান সর্বশেষ হামলাটি যখন চালায় তখন সেখানে রাত ১টা ৩০ মিনিট। ইসরায়েলি চ্যানেলগুলো তেলআবিবে ইরানি মিসাইলের আঘাত হানার দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করে। তাদের তথ্য, মিসাইলের আঘাতে অন্তত ৯১ জন আহত হয়েছেন, যার মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ অনেক মন্ত্রী-এমপি হামলার সময় সুরক্ষিত বাঙ্কারে অবস্থান নেন বলে জানায় ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো।
পাঁচবার আশ্রয়কেন্দ্রে যান মার্কিন রাষ্ট্রদূত : ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি বলেছেন, ইরানি হামলার মধ্যে একটি কঠিন রাত কাটিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মুখে তাকে পাঁচবার আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। এক্সে তিনি বলেছেন, ‘এখানে সুনসান নীরবতা। আমি কেন, পুরো ইসরায়েলকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে বলা হয়েছে। সবাই আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটছেন, আমিও।’ ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক হাকাবি, যিনি বলেছিলেন- পশ্চিমতীর বলতে কিছুই নেই, এই সপ্তাহের শুরুতে তিনি বলেছিলেন, মার্কিন অনুমোদন ছাড়া ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের হামলা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ইরানের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি হামাসের : ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনে হামাস ইসরায়েলে ইরানি হামলার প্রশংসা করে বলেছে, ইসরায়েলের তথাকথিত উচ্চমানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। সংগঠনের সিনিয়র নেতা ইজ্জত আল-রিশক ‘আয়রন ডোম’ ও ‘ডেভিডস স্লিং’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে ইরান যে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে, তার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ইরানের দৃঢ় প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করেছে, সব অহংকারের শক্ত প্রতিক্রিয়া হবে এবং সব আগ্রাসনকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এর আগে ইসরায়েলকে প্রতিহত করতে এবং ইহুদিবাদী অপরাধ বন্ধ করতে বিশ্বের প্রতি একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানায় হামাস। টেলিগ্রামে এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, ‘ইসরায়েলের আগ্রাসন একটি বিপজ্জনক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে, যা এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এটি চরমপন্থি নেতানিয়াহু সরকারের জেদের প্রতিফলন, যিনি এ অঞ্চলকে উন্মুক্ত সংঘাতের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চান।’ হামাস ইরানের ওপর হামলাকে একটি নৃশংস আগ্রাসন ও আন্তর্জাতিক নিয়ম ও প্রথার চরম লঙ্ঘন বলে অভিহিত করে বলেছে, এই হামলা আবারও নিশ্চিত করল, ইসরায়েল সমগ্র অঞ্চলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। হামাস ইরানের প্রতি পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেছে এবং সিনিয়র কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের মৃত্যুর জন্য ইরানি নেতৃত্ব ও জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছে।
ট্রু প্রোমিজ থ্রি ঠেকাতে ইসরায়েলকে মার্কিন সহায়তা : রয়টার্স জানিয়েছে, গত শুক্রবার রাতে ইসরায়েলের সামরিক ও বিমান ঘাঁটিগুলোতে একযোগে হামলা চালায় ইরান। আর এ হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলকে সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি শুক্রবার রাতে এ হামলা চালানোর কথা জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ট্রু প্রোমিস থ্রি’ শিরোনামে এই অভিযান শুরু হয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, ইরান ১০০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, যেগুলোর বেশিরভাগ তারা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছেন। দুই মার্কিন কর্মকর্তার বরাতে রয়টার্স বলেছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ইসরায়েলকে সহায়তা করেছে। ভূমিতে স্থাপিত ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থার মাধ্যমে বেশকিছু মিসাইল ভূপাতিত করা হয়েছে। এদিকে, ইরানের সঙ্গে সমন্বয় করে ইসরায়েলে ড্রোন হামলা চালিয়েছেন ইয়েমেনের হুথি আনসার আল্লাহর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী। অন্তত তিনটি ড্রোন ইসরায়েলের দিকে ছোড়া হয় বলে জানিয়েছে আলজাজিরা। তবে ড্রোনগুলো প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে আইডিএফ।
ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিল চীন-রাশিয়া : জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত ফু কং বলেছেন, ইরানের ওপর হামলা চালিয়ে ইসরায়েল আরেকটি রেডলাইন অতিক্রম করেছে। ইরানের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ অখণ্ডতা লঙ্ঘনের জন্য ইসরায়েলের তীব্র নিন্দা জানান তিনি। চীনা সংবাদমাধ্যম সিসিটিভিকে দেওয়া বক্তব্যে ফু বলেন, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা করায় তিনি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। এটি এমন একটি রেডলাইন, যা ইসরায়েলের অতিক্রম করা উচিত হয়নি। তিনি বলেন, বেইজিং মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বিস্তারের বিরোধিতা করে এবং ইসরায়েলের এসব কর্মকাণ্ডের পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, ‘এই ধরনের পদক্ষেপ ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আমরা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে আহ্বান জানাই যেন তারা উত্তেজনা না বাড়িয়ে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভূমিকা রাখে।’ রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘ইসরাইলের এই আগ্রাসন অগ্রহণযোগ্য ও উসকানিমূলক।’ রাশিয়ার তেল আবিব দূতাবাস দেশটিতে অবস্থানরত রুশ নাগরিকদের ইসরায়েল ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইরানে আবার হামলা : ইসরায়েল শনিবার সকালেও ইরানে হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরান ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো ইরানের উত্তরাঞ্চলে তেহরান থেকে প্রায় ৩২৫ কিলোমিটার দূরে জানজান শহরের একটি সেনাঘাঁটিতে বোমাহামলা চালায়। হামলার পর সেখানে কমলা রঙের ঘন ধোঁয়া ও আগুন জ্বলতে দেখা যায়। হামলা হয়েছে তেহরানের মেহরাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও। এর আগে শুক্রবার ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে ইরানে একটি বড় ধরনের অভিযান চালায়। এতে দেশটির বেশ কয়েকটি পরমাণু স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ কারখানা এবং সামরিক কমান্ড সেন্টারে হামলা চালানো হয়। টাইমস অব ইসরায়েলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, ইরানে মোসাদ এজেন্টরা গোপনে একটি ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন। সেখান থেকেই পরিচালিত হয় হামলা। এতে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়ে যায় বলে দাবি করা হয়। ইসরায়েলের হামলায় ইরানি সেনাপ্রধান, আইআরজিসি প্রধান ও অন্য ১৮ জন সামরিক কমান্ডারসহ অন্তত ৭৮ জন নিহত এবং ৩২৯ জন আহত হয়েছেন। হতাহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক ব্যক্তি। দেশটির রেভল্যুশনারি গার্ড পরিচালিত সংবাদ মাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বাস্তব হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। সৌদি আরব, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশ এরইমধ্যে এ সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না এলে তা পুরো অঞ্চলের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও প্রেসিডেন্ট ছিলেন হামলার লক্ষ্য : নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে লক্ষ্য করে হামলার চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরায়েল। সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, তেহরানের পাস্তুর এলাকায় ইসরায়েলি হামলা রুখে দিতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করছে দেশটির বাহিনী। আর ওই এলাকায় থাকেন মাসুজ পেজেশকিয়ান ও আয়াতুল্লাহ খামেনি। সেখানকার বাসিন্দারা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ওই এলাকায় অব্যাহতভাবে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে মিসাইল ছোড়া হচ্ছে, যেন ইসরায়েলি মিসাইল সেখানে কোনোভাবে আঘাত না করতে পারে।
সবই আগে থেকে জানতেন ট্রাম্প : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফক্স নিউজকে বলেছেন, ইরানে ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি আগে থেকেই জানতেন। তবে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, মার্কিন সামরিক বাহিনী এই অভিযানে কোনো ভূমিকা রাখেনি। তিনি আশা করেন, ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে। ফক্স নিউজকে ট্রাম্প বলেন, ‘ইরান পারমাণবিক বোমা রাখতে পারে না এবং আমরা আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার আশা করছি। আমরা দেখব।’ ট্রাম্প উল্লেখ করেন, হামলায় একাধিক ইরানি নেতার মৃত্যু হয়েছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নেতৃত্বে থাকা বেশ কয়েকজন যারা নিহত হয়েছেন, তারা আর ফিরে আসবেন না।’ তিনি জানান, তার প্রশাসন হামলার আগে মধ্যপ্রাচ্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের অবহিত করেছিল। তবে তিনি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করবে না ইরান : ইরান বলেছে, ইসরায়েলের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু আলোচনা অর্থহীন। তাসনিম নিউজের সঙ্গে কথা বলার সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাকাই ইসরায়েলি হামলায় মার্কিন সমর্থনের কথা তুলে ধরে বলেন, ওয়াশিংটনের অনুমতি ছাড়া ইসরায়েল এই হামলা করেনি। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এমন কাজ করেছে, যার পর সংলাপ এখন অর্থহীন। একদিকে ইসরায়েল সরকারকে হামলার অনুমতি দেবেন, অন্যদিকে আলোচনার কথা বলবেন, দুইটা একসঙ্গে চলতে পারে না।’
বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া : ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাসহ একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলি হামলার পর বিশ্বনেতারা দুইপক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘এই অপরাধের জবাবে ইরানের বৈধ ও শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া ইসরায়েলকে অনুতপ্ত করবে। ইরানি জাতি ও নেতৃত্ব চুপ থাকবে না।’ জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস দুই পক্ষকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই সংঘাত আরও গভীর হলে তা গোটা অঞ্চলের জন্য মারাত্মক হবে।’ বিশেষ করে পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার ঘটনায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কায়া কাল্লাস বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। উত্তেজনা না বাড়িয়ে কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।’ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘সর্বোচ্চ সংযম বজায় রাখতে হবে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন করা যাবে না।’ জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘আমরা কূটনৈতিক সব উপায় ব্যবহার করে এই সংঘাতে জড়িত পক্ষদের প্রভাবিত করতে প্রস্তুত। আমাদের লক্ষ্য, ইরান যেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে।’ লেবাননের হিজবুল্লাহ বলেছে, ‘ইসরায়েল কোনো যুক্তি বা আইন মানে না, তারা কেবল আগ্রাসনের ভাষা বোঝে। এই হামলা গোটা অঞ্চলকে আগুনে ঝলসে দিতে পারে।’ ইরাক বলেছে, ‘এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন এবং বৈশ্বিক শান্তির প্রতি সরাসরি হুমকি।’ জর্ডান জানায়, ‘তারা কখনও তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন মেনে নেবে না এবং দেশটিকে কোনো সংঘাতের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে দেবে না।’ পারমাণবিক আলোচনার মধ্যস্থতাকারী দেশ ওমান বলেছে, ‘এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত স্পষ্ট ও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা।’ কাতার ইসরায়েলি হামলার ‘তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ’ জানিয়ে বলেছে, এই উত্তেজনা কূটনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেন, ‘ইসরায়েলের এই হামলা আন্তর্জাতিক আইনকে অবজ্ঞা করে, যা স্পষ্ট উসকানি। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত এই দস্যুতার অবসান ঘটানো।’ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, ‘সব পক্ষের উচিত উত্তেজনা থেকে সরে আসা। সংঘাত কারওই মঙ্গল বয়ে আনবে না।’ ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহ বলেছে, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনার বৈধ অধিকার রয়েছে এবং ইসরায়েলের নৃশংস হামলার প্রতিক্রিয়া জানানোর পূর্ণ অধিকার আছে তেহরানের।’
ইসরায়েলের ১৫০ স্থাপনায় আঘাত হেনেছে ইরান : ইরানের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ ওয়াহিদি বলেছেন, ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক অভিযানের সময় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের কমপক্ষে ১৫০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। তার ভাষায়, ‘আইআরজিসি অ্যারোস্পেস ডিভিশন পরিচালিত অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩ অভিযানের প্রথম ধাপ সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে’।
ইসরায়েল ও মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা অব্যাহত রাখার হুমকি ইরানের : ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের হামলা অব্যাহত থাকবে। গতকাল শনিবার উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি করে ইরানের ফার্স নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। সামরিক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ফার্স আরও জানিয়েছে, ‘গত রাতের সীমিত অভিযানে এই সংঘর্ষ শেষ হবে না। ইরানের হামলা অব্যাহত থাকবে। এই পদক্ষেপ আগ্রাসীদের জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও অনুশোচনীয় হবে।’ সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘এই যুদ্ধ আগামী দিনগুলোতে ইসরায়েলি শাসন ব্যবস্থার দখলকৃত সব অঞ্চল এবং অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে।’
ইসরায়েলের বিমানবন্দর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ : ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের মুখপাত্র লিসা ডাইভারের বরাত দিয়ে আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পুনরায় খোলার জন্য এখনও কোনো দিন বা তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। বিমানবন্দর থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, চেক-ইন কাউন্টার ও যাত্রী লাউঞ্জগুলো ফাঁকা। ফ্লাইট তথ্য বোর্ডে সব ফ্লাইট বাতিল দেখানো হয়েছে। ইরানে ইসরায়েলের হামলার পরপরই জর্ডান গত শুক্রবার সাময়িকভাবে তার আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে গতকাল সকালে ফ্লাইট চলাচল আবার শুরু হয়েছে বলে সিএনএনকে জানিয়েছে দেশটির বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল কর্তৃপক্ষ।