মৌলিক সংস্কার ও জুলাই আন্দোলনে নির্বিচার মানুষ হত্যার বিচারের দৃশমান অগ্রগতি ছাড়া নির্বাচনের দিকে এগোনো জাতির সঙ্গে এক ধরনের প্রহসন বলে মনে করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি মনে করে, নির্বাচন কবে হবে, সেটার চেয়ে মৌলিক সংস্কার ও জুলাই সনদ ঘোষণা আগে দরকার।
জানা গেছে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য ভোটের সময়সীমা নির্ধারণ করায় রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বৈঠকটি প্রথমে ইতিবাচকভাবে দেখছিল এনসিপি। কিন্তু, বৈঠক শেষে বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের যৌথ বিবৃতির পর সেই ভাবনা পাল্টে গেছে দলটির। কারণ মৌলিক সংস্কার ও বিচারের চেয়ে আগামী নির্বাচনের ইস্যুকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এনসিপি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচনসংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মধ্যকার বৈঠকে সংসদ নির্বাচন বিষয়ে দলটিকে আস্থায় আনতে সফল হয়েছে সরকার। কিন্তু বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রধান দাবি তথা বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। এটা হতাশাজনক বলে মনে করে এনসিপি। ০এসব বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন গতকাল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক করতে লন্ডনে গেছেন। সেখানে একটি দলের প্রধান ও একটি দেশের প্রধান বৈঠক শেষে কীভাবে যৌথ বিবৃতি দেয়। যৌথ বিবৃতিটি আমাদের অবাক করেছে। মনে হচ্ছে, তিনি (ড. ইউনূস) বিএনপির মনোনীত একজন প্রধান উপদেষ্টা। সেজন্য বিএনপির কথামতোই চলছেন। এরই অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার মৌলিক সংস্কার ও বিচারকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’ আরিফুর রহমান তুহিন বলেন, ‘জুলাই সনদ ঘোষণাপত্র নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দুই দফা পিছিয়েছে। এভাবেই কালক্ষেপণ করে বিএনপির কথামতো নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। একটি পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনের আগে অবশ্যই মৌলিক সংস্কার ও জুলাই হত্যকাণ্ডের বিচার হতে হবে। এরপরে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, কারণ বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিএনপির নির্বাচন কমিশন। বিএনপি ২০০৫-৬ সালে যেভাবে আজিজ কমিশন করেছিল, সেই আজিজ কমিশনের সঙ্গে বর্তমান কমিশনের খুব একটা পার্থক্য নেই। বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে নতুন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন হতে হবে।’
আরিফুর রহমান তুহিন আরও বলেন, বিএনপির কথামতো প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করলে সেটি হবে প্রহসনের নির্বাচন। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন চায়। কিন্তু সেই নির্বাচন গত ৫৪ বছরের মুজিববাদী সংবিধান কিংবা শেখ হাসিনার বানানো আইনের অধীনে সম্ভব নয়। সেজন্য মৌলিক সংস্কার করতে হবে। মৌলিক সংস্কার ও জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সব রাজনৈতিক দল আস্থা ফিরে পাবে। অন্তর্বর্তী সরকার সব সংস্কার কাগজে-কলমে রেখে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদীন শিশির গতকাল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘একটি দলের প্রধানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করতেই পারেন, কিন্তু সেই বৈঠকে সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, মৌলিক সংস্কার ও বিচারকে প্রধান্য দেওয়া হয়নি, যা জুলাই শহিদের রক্তের সঙ্গে প্রতারণার সামিল। যা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিরপেক্ষ আচরণ করেননি। বৈঠকে বিএনপির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো একটি আচরণ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যই জুলাই-আগস্টের বিপ্লব সাধিত হয়নি, মৌলিক সংস্কারের জন্যই ছাত্র-জনতা বিপ্লবে নেমেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে হোক কিংবা আরও ছয় মাস পরে হোক, এতেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সবার আগে মৌলিক সংস্কার ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’ গত শুক্রবার লন্ডনে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে দলটির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, বর্তমান সরকার যদি সংস্কার, বিচার এবং সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হয় তাহলে এনসিপি দ্বিতীয় গণঅভ্যুত্থানের দিকে যেতে বাধ্য হবে। এমনকি এই সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হলে এনসিপি কোনো নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে না। তিনি বলেন, লন্ডনে বসে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের মিটিং দেশবাসীর স্বার্থ ও গণআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতারণা। শহিদদের রক্তকে অবমাননা করে বিদেশের মাটিতে মিটিং আয়োজন কখনওই মেনে নেওয়া যায় না। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে দেশের জনগণের মাধ্যমে, বিদেশি আলোচনায় নয়। নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর একটি সামাজিক চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু সেটিকে কার্যকর না করে দেশকে অন্য খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে। আজকের বাস্তবতায় নতুন করে একটি জাতীয় বন্দোবস্ত প্রয়োজন। আর এই বন্দোবস্ত হতে হবে জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে, কোনো একক দলের সুবিধার জন্য নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শহিদদের আত্মত্যাগ ও আহতদের কষ্টের মূল্যায়ন করতে হবে। গ্রামের মানুষের কাছে যেতে হবে, জানতে হবে তারা কী চায়। জনগণের বেদনার প্রতিফলন যদি সরকার বুঝতে পারে, তবেই বিচার ও সংস্কারের প্রক্রিয়ায় তারা সক্রিয় হবেন। বিএনপির অবস্থান নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিএনপি একসময় ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানালেও এখন রোজার আগের সময়সীমায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু তারা এখনও জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র, বিচার বা নতুন সংবিধান নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট প্রস্তাব দেয়নি। ফলে এটি বোঝা যাচ্ছে, তারা কেবল ক্ষমতার লোভে যুক্ত হয়েছে, গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করছে না।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি একযোগে দেশের জনগণকে পাশ কাটিয়ে একটি গভীর সংকট তৈরি করছে। জনগণ অতীতেও লড়াই করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সরকারই বৈধ হতে পারে না। নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী আরও বলেন, ‘সরকার এরই মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার যে তারিখ দিয়েছে, সেই জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই সনদ, মৌলিক সংস্কার এবং বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি হলে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই।