ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সেই তিন সিইসি কেমন আছেন, কোথায় আছেন

সেই তিন সিইসি কেমন আছেন, কোথায় আছেন

আওয়ামী লীগের শাসনামলের বিতর্কিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিন প্রাধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং নির্বাচন কমিশনাররা। জুলাই বিপ্লবের ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও বিতর্কিত এসব নির্বাচনের কারিগরদের বিচারের বিষয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। মামলা ও দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলেও এখনও কোনো কমিশনারকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি।

সূত্র জানায়, গত তিন কমিশনে সিইসিসহ মোট ১৫ জন নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। এরা সবাই বিতর্কিত নির্বাচনের সরাসরি সহযোগী ছিলেন। এদের মধ্যে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে আছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম। বাকি ১৩ জনের মধ্যে কেউ দেশে আত্মগোপনে রয়েছেন, আবার কেউ বিদেশে অবস্থান করছেন। তাদের অবস্থান কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। তাদের বিষয়ে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবে, এ নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা কাটেনি।

গত তিনটি নির্বাচন ছিল চরম বিতর্কিত। একতরফা ও জালিয়াতির এসব নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের বৈধতা নেওয়া হয়েছিল মাত্র। এই নির্বাচনগুলোতে ছিল না জনসম্পৃক্ততা। এসব নির্বাচন আয়োজনে বড় ভূমিকা ছিল নির্বাচন কমিশনের। জনআপত্তি উপেক্ষা করে সংশ্লিষ্ট কমিশন সরকারের পক্ষে নির্বাচন আয়োজন করে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত তিন সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা সচিবদের বিচার শুরু হলেও কমিশনারদের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধন্ত আসেনি। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের যেসব কর্মকর্তরা সরাসরি জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং অনেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, বিগত তিনটি নির্বাচনে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছি আমরা। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তাই বিগত তিনটি নির্বাচনের সঙ্গে জড়িতদের তদন্তের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

এদিকে, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল, কেএম নূরুল হুদা ও কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে প্রতারণা ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা হয়।

বাদীর আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, আদালত পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলসহ অনেক জনপ্রিয় নেতার অংশগ্রহণ ছিল না। সাধারণ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। যারা কমিশনে ছিলেন, তাদের ব্যর্থতার কারণে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নির্বাচনি মাঠে একপেশে আচরণ করেছে। বিপুল টাকা ব্যয়ে যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, তাতে সংবিধানের খেলাপ করেছেন নির্বাচন কমিশনারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাই রাষ্ট্রদ্রোহ ও প্রতারণা মামলা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব নির্বাচনে সংসদ সদস্য যারা নির্বাচিত হয়েছেন, অবৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করায় তাদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ, মো. জাবেদ আলী, আবদুল মোবারক, মো. শাহনেওয়াজ, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান, বেগম রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান, নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ ও জাহাঙ্গীর আলম।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ও ইন্ধনে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জনগণের সব গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, দেশের সংবিধান ও আইনকে লঙ্ঘন করে একপেশে, জনগণের অংশগ্রহণবিহীন ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে কিছু অনির্বাচিত লোককে সংসদ সদস্য ঘোষণা করেন। পরে তাদের মন্ত্রী ও স্পিকার ঘোষণা করা হয়। দেশের মানুষ ভোট দিতে না পারায় নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েন। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে গণতন্ত্র। দেশে স্বৈরাচারী লুটেরা ব্যবস্থার আবির্ভাব হয়। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করে দেন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা।

অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুল বারী ভূঁইয়া নারায়ণগঞ্জ জেলা জজ আদালতে মামলা করেন। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এ মামলা করা হয়। মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহম্মদ, কেএম নুরুল হুদা, কাজী হাবিবুল আউয়ালকে।

মামলার আর্জিতে বলা হয়, আসামিরা যড়যন্ত্রমূলক ভোটারবিহীন দশম (২০১৪), একাদশ (২০১৮) ও দ্বাদশ (২০২৪) জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজন করে এবং অধীনস্থদের ওই কাজ করতে বাধ্য করে। তারা অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করেন। আসামিরা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে বাংলাদেশকে অন্য রাষ্ট্রের করদ রাজ্যে পরিণত করেন। আর্জিতে আরও বলা হয়, এই তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত করা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে শামিল হয়েছিল তিনটি জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করে একটি দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অভিযোগের তীর সাবেক তিন কমিশনের সিইসি ও ইসিদের বিরুদ্ধে। আর এই অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদক সূত্র জানায়, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে নির্বাচনে ব্যবহার করা ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতামতের ঊর্ধ্বে গিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের অনুমোদন দেন। এসব মেশিন একপর্যায়ে অকেজো হয়ে পড়ে। হাজার কোটি টাকায় কেনা ইভিএম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ ক্ষতির বিষয়টিও অনুসন্ধানের আওতায় আসতে পারে।

দুদকের কর্মকর্তা জানান, নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম দুর্নীতি কী পরিমাণ হয়েছে এবং এর মধ্যদিয়ে সিইসি-ইসিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছেন, সে বিষয়ে একটি অনুসন্ধানের পরিকল্পনা রয়েছে দুদকের। তিনি বলেন, পরিকল্পনামাফিক অনেক কাজই দুদক করছে।

এ বিষয়ে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও ইসি সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনটি নির্বাচন বিতর্কিত ছিল; এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একটি পক্ষকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। গত নির্বাচনেও দুই হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। নির্বাচনে কী কী অনিয়ম হয়েছে, সেটা নিয়ে তদন্ত প্রক্রিয়াধীন।

কোন নির্বাচনে কত টাকা বাজেট ছিল : ২০১৪ সালের প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ভোটে কাজী রকিবউদ্দিন কমিশন ব্যয় করেছিল ২৬৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে নুরুল হুদা কমিশন সে ব্যয় বাড়িয়ে ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় করে। যদিও নির্বাচনে ব্যয় বেড়েছিল আরও বেশি। সর্বশেষ ২০২৪ সালে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের আমলে নজিরবিহীন ব্যয় হয়। এতে নির্বাচনের জন্য খরচ হয় প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা।

যেমন ছিল তিনটি নির্বাচন : ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার আড়াই বছর পর সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে আওয়ামী লীগ। দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের বিরোধিতা করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১২৫, জাতীয় পার্টি (জাপা) ২২, জাসদ দুই, ওয়ার্কার্স পার্টি দুই, জেপি এক এবং তরীকত ফেডারেশন একটি আসনে বিনা ভোটে জয়ী হয়। বাকি ১৪৭ আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়। দিনভর কেন্দ্র ফাঁকা থাকলেও ভোটের হার দেখানো হয় ৪০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

এরপর ‘রাতের ভোট’ খ্যাত ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। সেই নির্বাচনে আগের রাতেই ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভরা হয়। অস্বাভাবিক ফলাফলের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং বিএনপি ১৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে বলে দেখানো হয়। বিএনপি পেয়েছিল ছয়টি আসন। আওয়ামী লীগ ২৫৮ ও জাতীয় পার্টি ২২ আসন পায়।

একাদশ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার দেখানো হয় ৮০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। যদিও রাতের বেলায় বাক্স ভরার অভিযোগে নির্বাচনের দিন সকালে শতাধিক আসনে ভোট বর্জন করেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্য ফ্রন্টের প্রার্থীরা। চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায়, ১০৩ আসনের ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ১ হাজার ২০৫ কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়ে ৬ হাজার ৪৮৪ কেন্দ্রে। আর ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ ভোট পড়ে ১৫ হাজার ৭১৯ কেন্দ্রে, যা ছিল অস্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের শতাধিক প্রার্থী ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন বলে দেখানো হয়। তখন থেকেই প্রচলিত কথা ছিল রিটার্নিং, সহকারী রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নির্বাচনের আগে ব্যালটে সিল দিয়ে ভোটবাক্স বোঝাই করে পুলিশ। যদিও কেএম নুরুল হুদার নির্বাচন কমিশন এবং আওয়ামী লীগ সেই অভিযোগ নাকচ করে।

অন্যদিকে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারিতেও বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে আওয়ামী লীগ ডামি প্রার্থী দেয়। নিজ দলীয় নেতাদের মধ্যেই ভোটের আয়োজন করে। সে নির্বাচনের বৈধতা দেন তৎকালীন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত