ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

‘হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত আমার লাশ ঘরে আনবে না’

‘হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত আমার লাশ ঘরে আনবে না’

‘স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে গিয়ে আমার মৃত্যু হলে খুনি হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত তোমরা আমার লাশ ঘরে আনবে না।’ কথাগুলো ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লবের শহিদ টঙ্গী সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ফাহমিন জাফরের। কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন শহিদ ফাহমিন জাফরের মা। ফাহমিন জাফর ২৪-এর জুলাইয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঢাকার উত্তরা এলাকায় ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে উত্তরার একটি মার্কেটের সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েন। সহযোদ্ধা বন্ধুরা তাকে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ফাহমিন। ছররা গুলিতে সারাশরীর ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল তার। ফাহমিন জাফর নওগাঁর আত্রাই উপজেলার তারাটিয়া গ্রামের বাসিন্দা। মা-বাবার চার সন্তানের মধ্যে ফাহমিন ছিলেন সবার ছোট। বুয়েটে পড়াশোনা করার ইচ্ছা বুকে নিয়ে মা শিল্পী বানুর সঙ্গে ঢাকায় মামার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করত ফাহমিন।

শহিদ জননী শিল্পী বানু বলেন, ‘জাফরের জন্ম হয়েছিল ১০ জুলাই ২০০৬ সালে। সেই জুলাই মাসেই আমার বুকের মানিককে আমার কোল খালি করে রক্তপিপাসা নিবৃত্ত করেছে খুনি হাসিনা।’

‘যাচ্ছি বাবা- বলে চিরতরেই চলে গেল; সে আর কখনও ফিরে আসবে না আমাদের কাছে’- কথাগুলো আবেগাপ্লুত হয়ে বলছিলেন শেখ ফাহমিন জাফরের বাবা শেখ আবু জাফর। শেখ ফাহমিন জাফর গাজীপুরের টঙ্গী সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি।

নিহত হওয়ার আগে, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ফাহমিন তার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। আবু জাফর ছেলেকে ফোনে বলেছিলেন, ‘বাবা, তুমি এখন বাইরে কেন, বাসায় যাও বাবা।’ উত্তরে ফাহমিন বলেছিলেন, ‘যাচ্ছি বাবা’। কিন্তু এটাই যে তার শেষ যাওয়া হবে, তা বুঝে উঠতে পারেননি শেখ আবু জাফর। ছেলের সঙ্গে এটিই ছিল তার শেষ কথা।

২৮ জুলাই বিকেলে শেখ আবু জাফর মুঠোফোনে কথাগুলো বলছিলেন। শেখ আবু জাফর বর্তমানে থাকেন রাজশাহী নগরীর বোসপাড়া এলাকায়। তিনি রাজশাহীতে একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরিরত। তার তিন ছেলের মধ্যে শেখ ফাহমিন জাফর ছিলেন সবার ছোট।

ফাহমিন রাজশাহীর অন্যতম স্কুল রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ২০২৩ সালে এসএসসি পাস করে টঙ্গী সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। ১১ জুলাই তার প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাবা আবু জাফর বলেন, ‘ঢাকার দক্ষিণখান এলাকায় তার মাকে সঙ্গে নিয়ে মামার বাড়িতে থাকত ফাহমিন। ছেলেকে পড়ালেখা করানোর জন্যই মা কাজী লুলুল মাকমিন রাজশাহী ছেড়ে ঢাকার দক্ষিণখানে তার ভাইয়ের বাড়িতে থাকা শুরু করেছিলেন। ওই বাসা থেকেই ফাহমিন কলেজে যাতায়াত করত।’

বাবা আরও জানান, ফাহমিনের বড় হয়ে প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা ছিল। তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। ১৮ জুলাই দুপুরের দিকে গুলিবিদ্ধ ফাহমিনকে একটি মার্কেটের সিঁড়ি থেকে উদ্ধার করে তার বন্ধুরা উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি তাকে। ডান হাতের পেছনে পিঠের কাছে ছররা গুলিতে মৃত্যু হয় শেখ ফাহমিন জাফরের। ঢাকা থেকে লাশ এলে পরদিন নওগাঁর আত্রাইয়ের তারাটিয়া গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন হয়। শেখ ফাহমিন জাফরের মা কাজী লুলুল মাকমিন সন্তানের শোকে ভেঙে পড়েন। বিশ্বাস করতে পারছেন না তার আদরের সন্তান আর বেঁচে নেই।

মা কাজী লুলুল মাকমিন বলেন, ‘ফাহমিন কোলঘেঁষা সন্তান ছিল আমার। মাকেও খুব আদর-যত্ন করত। খুব মেধাবী ছিল আমার ছেলে; কবিতা লিখত, অভিনয় করত, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিত। ছবি আঁকানো না শেখানো সত্ত্বেও ভালো ছবি আঁকত। কলেজিয়েট স্কুলে থাকতে ম্যাথ অলিম্পিয়াডেও পুরস্কারও পেয়েছিল।’ ‘আমাদের ইচ্ছা ছিল ও ডাক্তার হবে। কিন্তু ওর ইচ্ছা ছিল প্রকৌশলী হওয়ার; বুয়েটে পড়ার। আমরা তার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতাম।’ ফাহমিনের মা আরও বলেন, ‘ঘটনার দিন সকাল ১০টার দিক বাসা থেকে বের হয়ে যায় ফাহমিন। যাওয়ার সময় আমার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে যায়। ন্যায্য দাবি বলে আমি কখনও তাকে নিষেধ করিনি। সাড়ে ১০টার দিকে ফাহমিন তার বাবার সঙ্গে কথা বলে। দুপুর ২টার পর খবর পাই ফাহমিন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত