আজ ১৬ জুলাই। ২০২৪ সালের এই দিনে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ। এই দিনে ছয়জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ২ যুবক, চট্টগ্রামে দুই শিক্ষার্থী ও এক পথচারীসহ ৩ জন এবং রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ (২২) নিহত হয়েছেন। রক্তাক্ত একটি দিন দেখেছেন দেশবাসী। দফায় দফায় হামলা, ধাওয়া-পালটাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের গুলিবর্ষণ ও রাবার বুলেট নিক্ষেপে রাজধানীর ঢাকা কলেজ ও সায়েন্স ল্যাব এলাকা, চট্টগ্রাম নগরী, রংপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মোড়ে মোড়ে ব্লকেডে রাজধানী অচল হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী ও রংপুরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণার পর রাত ১২টার দিকে ঢাবির বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেসা ও সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।
রাজধানীর ঢাকা কলেজের সামনে আন্দোলনরতদের সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে দুইজন নিহত হন। তাদের একজনের নাম মো. শাহজাহান (২৫), অন্যজন সবুজ আলী (২৫)। চানখাঁরপুল এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের সময়ে প্রতিপক্ষের গুলিতে অন্তত চারজন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হোন। মাথায় হেলমেট পরে এসব লাঠিসোঁটা নিয়ে মহড়াও দেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল, অমর একুশে হল, চানখাঁরপুল মোড় ও পলাশী এলাকার নিয়ন্ত্রণে রাখে আন্দোলনকারীরা। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মাথায় ছিল জাতীয় পতাকা ও কোটাবিরোধী স্লোগান সংবলিত কাপড়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের মুখোমুখি অবস্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সরেজমিন দেখা যায়, পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমাবেশ করে ছাত্রলীগ। সমাবেশে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন তার বক্তব্যে সোমবারের সংঘর্ষের সূত্রপাতের ঘটনা তুলে ধরেন। আন্দোলনকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলন যাবে, আন্দোলন আসবে, ছাত্রলীগ থেকে যাবে। আমরা সবকিছু দেখছি, খোঁজ রাখছি এবং সবকিছু মনে রাখছি। সবকিছুরই জবাব দেওয়া হবে। কত ধানে কত চাল হয় তা ছাত্রলীগ দেখে নেবে বলেও জানান তিনি।
জবিতে গুলিবিদ্ধ ৪ শিক্ষার্থী : কোটা সংস্কারের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলির ঘটনা ঘটে, এতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন ও সরকারি কবি নজরুল কলেজের ১ জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্দোলনকারীরা জানান, পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা এ গুলি বর্ষণ করেছে। গুলিবিদ্ধ হওয়া ৪ জন হলেন-জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ ব্যাচের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী অনিক, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ১৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ফেরদৌস জামান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ১৬ ব্যাচের এইচএম নাসিম ও কবি নজরুল কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী হাসিব।
চট্টগ্রামে দুই শিক্ষার্থী ও এক পথচারীসহ নিহত ৩, আহত ৬০ : চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ, হামলা-পালটা হামলায় দুই শিক্ষার্থী এবং এক পথচারীসহ তিনজন নিহত হয়। আহত হয় অন্তত ৬০ জন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের মধ্যে ধাওয়া-পালটাধাওয়া এবং পাঁচটার দিকে গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ ইট-পাটকেল নিক্ষেপের মধ্যদিয়ে ষোলশহর রেল স্টেশন, দুই নম্বর গেট থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তারা কোনো পক্ষকেই থামাতে পারেনি। ঘটনার সময় মুরাদপুর এলাকায় অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে একাধিক যুবককে সড়কে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ করতে দেখা গেছে। সংঘর্ষে চট্টগ্রাম কলেজে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক নিহত হয়। তার নাম ওয়াসিম আকরাম (২২)। নিহত অপর শিক্ষার্থীর নাম ফয়সাল আহমদ শান্ত (২০) তিনি এমইএস কলেজের অনার্স প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী। নিহত পথচারীর নাম মোহাম্মদ ফারুক। তিনি শুলকবহরে শাহজালাল ফার্নিচার নামে একটি দোকানের কর্মচারী। বহদ্দার হাট থেকে দোকানে যাওয়ার পথে হামলাকারীদের মুখে পড়েন। এর মধ্যে দুই শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। পথচারী ফারুককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি চট্টগ্রামে দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা চার প্লাটুন বিজিবি চেয়েছিলাম। দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েনের বিষয়ে কনফার্ম করা হয়েছে। আন্দোলনকারীরা ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও অন্তত ৬০ জন আহত হয়েছেন।’
সরেজমিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর রেল স্টেশন এলাকায় লাঠিসোঁটা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী আন্দোলনকারীরা ষোলশহর স্টেশনে এসে জড়ো হলে ছাত্রলীগ কর্মীরা তাদের লাঠিসোঁটা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
আন্দোলনকারী চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী মো. ইরফান বলেন, ‘আমরা সকালে ষোলশহরে জড়ো হতে চাইলেও ছাত্রলীগ আমাদেরকে ধাওয়া দেয়। পরে আমরা মুরাদপুর মোড়ে অবস্থান নিই। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করলেও ছাত্রলীগ অস্ত্র ও চাপাতি নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করে। একাধিক অস্ত্রধারী আন্দোলনকারীদের লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করে। মুরাদপুর এলাকায় আন্দোলকারী কয়েকজনকে ঘিরে ধরে হেলমেট পরিহিত ছাত্রলীগ কর্মীরা লাঠিসোঁটা দিয়ে আঘাতের পাশপাশি চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে। কাউকে আবার ছুরিকাঘাতও করে।’
রংপুরে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত ১, আহত অর্ধশতাধিক : কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নামে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়। আহত হয়, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীসহ অর্ধশতাধিক। নিহত শিক্ষার্থীর লাশ হাসপাতাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে আসার পথে পুলিশ ছিনিয়ে নেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রংপুরে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি চার প্লাটুন মোতায়েন করা হয়। নিহত সহপাঠীর লাশ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্ট্রেচারে করে মিছিল নিয়ে আসার পথে পুলিশ লাইনস এর সামনে তাদের গতিরোধ করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশের গাড়ির সামনে শুইয়ে পড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললে পুলিশ লাশ ছিনিয়ে নিয়ে গাড়িতে করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে নিয়ে যায় এবং সেখানে রাখে। নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদ বেরোবির ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার বাবার নাম মকবুল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার জাফরপাড়া বাবনপুরে বলে জানা গেছে। তিনি এই আন্দোলনে বেরোবি শাখার সমন্বয়ক ছিলেন।
তালা ভেঙে কুবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, গুলিতে আহত ১ : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটকাতে ছাত্রলীগের দেওয়া তালা ভেঙে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। পরে মহাসড়কে অবস্থান করছিলেন তারা। মিছিল চলাকালে পুলিশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দিকে গুলি করলে এক শিক্ষার্থীর বুকে তিনটি রাবার বুলেট ছোড়ে। এসময় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, কুমিল্লা সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী যোগ দেন।
পুলিশের গুলিতে জাবি অধ্যাপক আহত : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী-পুলিশ-ছাত্রলীগ ত্রিমুখী সংঘর্ষে দুই অধ্যাপকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। আন্দোলনকারীদের দমাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে পুলিশ গুলি চালালে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. খো. লুৎফুল ই এলাহী মারাত্মকভাবে আহত হন। সন্ধ্যায় আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ থামাতে গেলে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আওলাদ হোসেন আহত হন। এছাড়া রাতভর সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিন প্লাটুন পুলিশ কাজ করে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নুরুল আলমের বাসভবনে আশ্রয় নিলে তাদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়।
বগুড়ায় ককটেল হামলা, চার শিক্ষার্থী আহত : বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর ককটেল হামলা করা হয়। এতে কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের চার শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়।
ফরিদপুরে ছাত্রলীগের হামলা, আহত ৫ : ফরিদপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে অন্তত পাঁচজন আন্দোলনকারী আহত হয়। গুরুতর আহতরা হলেন বিল্লাল কাজীর ছেলে কাজী নিশাত আহমেদ (২৫) ও সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত আবরার নাদিম ইতু (২৬)।