চলমান উদ্ভূত পরিস্থিতি উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে ‘অতি দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা’ বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গতকাল বুধবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের এক বৈঠকের পরে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব এই মন্তব্য করেন।
গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাতীয়তাবাদী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী দলের নেতাদের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের এ বৈঠক হয়। আগামী ৩০ আগস্ট ময়মনসিংহে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সমাবেশ উপলক্ষে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জাতীয়তাবাদী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী দলের সভাপতি মৃগেন হাগিদের নেতৃত্বে ২০ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিজন কান্তি সরকার উপস্থিত ছিলেন। জাতীয়তাবাদী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী দল ২০০৭ সালে ১৮ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে। বৈঠকের পরে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকেছিলেন। আমরা আলোচনা করেছি, আমরা পূর্বের যে কমিটমেন্ট টু কোঅপারেট উইথ দ্য ইন্টেরিম গভর্মেন্ট, তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করার কথা আমরা বলে এসেছি। একইসঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দ্রুত করা, ত্বরান্বিত করা এবং ওনার (প্রধান উপদেষ্টা) যে প্রতিশ্রুতি ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া হবে- আমরা মনে করি অতি দ্রুত সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
‘এ ব্যাপারে ঘোষণা দিয়ে আর যেন কোনো অস্পষ্টতা না থাকে সেই ব্যবস্থাটা নেয়া উচিত। দলের তরফ থেকে আমরা সেটা ওনাকে বলে এসেছি। এটুকু বলেছেন তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) সেই ব্যবস্থাটা নেবেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা সবসময় যেটা চাইব, অতি দ্রুত নির্বাচন করে- নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। রাজনৈতিক সরকার না থাকলে এই সমস্যাগুলো আরও বৃদ্ধি পায়, সেজন্য আমরা সেটাই (প্রধান উপদেষ্টাকে) বলেছি।’
ফেব্রুয়ারির টার্গেটে সরকার এগোচ্ছে কি না প্রশ্ন করা হলে বিএনপি মহাসচিব স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমি তো দেখছি এগোচ্ছে।’
‘ঘন ঘন মতবিনিময় হওয়া উচিত’: মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ক্রাইসিস সৃষ্টি হলে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের ডাকেন আমি যাই। তবে আমি মনে করি, এই এনগেজমেন্টটা ঘন ঘন হলে আরও ভালো হতো, তাহলে হয়তো সমস্যাগুলো তৈরি হতো না।’
গত সোমবার যেটা হয়েছে, একটি বিমান দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক কচি প্রাণ মারা গেছে, আমি নিজেও পরশু দিন দেখতে গিয়েছিলাম এবং আমাদের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শোক জানিয়েছেন, সবাই সমবেদনা জ্ঞাপন করেছে। তার ফলে মঙ্গলবার উদ্ভূত যেটা সমস্যা হয়েছে- মূলত মাইলস্টোন স্কুলে দুজন উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিবকে তারা (শিক্ষার্থীরা) অবরুদ্ধ করে রেখেছিল এবং সচিবালয়ে পরীক্ষা সংক্রান্ত জটিলতায় ছাত্ররা ভেতরে ঢুকে পড়ে। যেটা আমার কাছে মনে হয়েছে, সবার কাছে মনে হয়েছে- এটা একটা প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে এবং একটা ল অ্যান্ড অর্ডার সিচ্যুয়েশন তৈরি হয়েছিল আপনারা দেখেছেন সবাই।’
তিনি বলেন, ‘তার কিছু দিন আগে আপনারা দেখেছেন, গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শক্তিরা যেভাবে একটা ‘রেইন অব টেরর’ সৃষ্টি করেছিল, আমরা মনে করি- গণতন্ত্র উত্তরণের আমাদের যে প্রক্রিয়া চলছে, জুলাই-আগস্টে কর্মসূচি চালানোর মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শক্তিকে পরাজিত করা হয়েছে— সেটা এই জুলাই-আগস্ট মাসেই। ওই শক্তির আবারও উত্থানের একটা নমুনা দেখার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে।’
‘এটার জন্যই প্রধান উপদেষ্টা সম্ভবত আমাদের, যারা ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, লড়াই করেছেন- তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে এই সভা ডেকেছিলেন। আমরা আমাদের পূর্বের যে কমিটমেন্ট সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা, সেটা বলেছি।’
‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য অটুট আছে’: মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ঐক্য অবশ্যই অটুট আছে। আপনারা মিডিয়াতে যেটা দেখেন বা আসে বা আপনারা দেখান- রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কথার ছড়াছড়ি, এদিকে কখনও পক্ষের কথা, কখনও কখনও বিপক্ষের কথা, বকাবকি- এগুলো রাজনীতিতে থাকবেই। রাজনীতির মানেই হচ্ছে প্রতিপক্ষকে কথা দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করা, নিজেরটাকে স্টাবলিস করার চেষ্টা করা। সেটা নিয়ে আমরা চিন্তিত না, কারণ রাজনীতির নিয়মটাই তাই। সুতরাং, এই ধারা থাকবে, সেটা থেকেই রাজনীতি এগোবে। রাজনীতি থাকলেই দেশের জন্য মঙ্গল এই কথাবার্তার মধ্য দিয়ে।’
গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে শত ফুল ফুটতে দিতে হবে আপনাকে, গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে সকলকে কথা বলতে দিতে হবে, গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে প্রত্যেকের কথা শুনতে হবে। এটা হলেই শত ফুল ফুটবে, ভালো সৌরভের সুবাতাস বয়ে আসবে।
‘দলীয়প্রধান কী সরকারপ্রধান হতে পারবে?’: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে দলের মহাসচিব বলেন, ‘এটা একটা প্রস্তাব তাদের (জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের)। এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আলোচনার মধ্য দিয়ে আসবে।’ আমরা আমাদের মতামত দিয়েছি, অন্যান্য দলও দিয়েছে। এখন দেখা যাক- আলোচনার মধ্য দিয়ে কোনটা প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘উত্তরায় প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে’: মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখছি, তারাও (সরকার) দুর্ঘটনা হিসেবে দেখছে। এটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।’
‘কারণ আমি যদ্দুর শুনেছি, আমি বিশারদ নই, বিশেষজ্ঞ নই্, আমি শুনেছি যে এই এয়ারক্রাফ্টটা ওদের ট্রেনিংয়ের এয়ারক্রাফট। অনেকে বলেছেন, আগেও নাকি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমি জানি না, হতে পারে। কিন্তু এটা পাইলটের ট্রেনিংয়ের শেষ পর্যায়ে তাকে একা ফ্লাইটটা নিতে হবে। এখানে সামথিং ওয়াজ রং হতেই পারে। কিন্তু এয়ারক্রাফটটাকে সেফ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন- যাতে স্কুলের ওপরে না পড়ে। কিন্তু সে সেটা পারেনি।’
এই দুর্ঘটনার পর সরকারের পদক্ষেপগুলো সঠিক ছিল বলে আপনি মনে করেন কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, কিছু কিছু জায়গায় হয়তো তাদের অভিজ্ঞতার কারণে কিছু ল্যাপসেস ছিল। এটা আমি মনে করি সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতার ব্যাপার।’
এই সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যাটা কোথায় জানেন? তাদের অভিজ্ঞতাণ্ডঅনভিজ্ঞ লোকেরাই বেশি আছেন। তাদের অভিজ্ঞতার অভাব আছে। আর কিছু কিছু মানুষের মধ্যে একটা সমস্যা হচ্ছে- ইগো কাজ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর যে অভিজ্ঞতা আছে, বিশেষ করে যারা সরকারে ছিল। যেমন- আমরা, আমাদের সঙ্গে কথা বলা, পরামর্শ নেওয়া, মাঝে মধ্যে কথা বলা- এই বিষয়গুলোতে তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) একটু পিছিয়ে। আমি মনে করি এটা তাদের অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে।
‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে কীভাবে দেখছেন?’: মির্জা ফখরুল বলেন, ‘কিছু কিছু বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। এটাও হতে পারে যে ডেফিনেটলি সেই ঘটনা, গোপালগঞ্জের ঘটনা, এটার সঙ্গে রাজনীতি জড়িত। নির্বাচন বানচাল করার একটা চক্রান্ত অবশ্যই আছে। আর সচিবালয়ে ঢুকে পড়া, সেখানেও কয়েকজন ফ্যাসিস্টের লোকজনকে আটক করা এবং তাদের সেখানে দেখা—বোঝা যাচ্ছে যে তাদের কিছু কিছু সমস্যা তৈরি করার চেষ্টা সেখানে আছে।’
‘এটা কখনোই সফল হবে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন আছে। তারা সব প্রচেষ্টাকে, সব চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দেবে’- বলেন মির্জা ফখরুল।