ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বদরুদ্দীন উমর আর নেই

* প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের শোক * আজ শ্রদ্ধা জানাতে বদরুদ্দীনের লাশ নেওয়া হবে শহিদ মিনারে
বদরুদ্দীন উমর আর নেই

বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৯৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। আজ সকালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে ঢাকার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সকাল ১০টা ৫ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম এ তথ্য সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, গত ২২ জুলাই শ্বাসকষ্ট ও নিম্ন রক্তচাপ নিয়ে বদরুদ্দীন উমর হাসপাতালে ভর্তি হন। দীর্ঘ ১০ দিন চিকিৎসা শেষে গত সপ্তাহে তিনি বাসায় ফেরেন।

বদরুদ্দীন উমর ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ভারতের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবুল হাশিম ভারতীয় উপমহাদেশের একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন।

ষাটের দশকে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আর ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর লেখা বইগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁর চিন্তা বুঝতে সহায়ক বিশেষ করে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৬), ‘সংস্কৃতির সংকট’ (১৯৬৭), ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৯)-তিনটি বই। এই বই লিখেই তিনি ক্ষান্ত হননি। শাসকদের অধীনে চাকরি পর্যন্ত করবেন না, এ মনোভাব পোষণ করে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন বদরুদ্দীন উমর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে তার পেশাজীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এক সময় তিনি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং এর সভাপতির দায়িত্ব নেন।

বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক : মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলন সংগ্রামের অন্যতম অগ্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও লেখক বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল রোববার এক শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করে পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়া বদরুদ্দীন উমর ছিলেন আমাদের মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতি সংগ্রামের এক উজ্জ্বল বাতিঘর। ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা, গবেষণা, ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শনের প্রতি তাঁর অবিচল নিষ্ঠা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী সরকারের পরিবর্তনের জন্য গোড়া থেকেই গণঅভ্যুত্থানের কথা বলেছেন এবং জুলাই আন্দোলনকে উপমহাদেশের একটি অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি দিয়েছেন।

প্রফেসর ইউনূস বলেন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর শুধু একজন তাত্ত্বিক ছিলেন না, ছিলেন একজন সংগ্রামী, যিনি আজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে সরকার।

বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যু জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তাশীল মানুষদের জন্য তাঁর লেখনী ও জীবনদর্শন এক অনন্য পথনির্দেশ হিসেবে কাজ করবে। শোকবার্তায় বদরউদ্দীন উমরের শোকসন্তপ্ত পরিবার, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান প্রধান উপদেষ্টা।

বদরুদ্দীন উমর ছিলেন স্বাধীন বিবেকের প্রতীক -তারেক রহমান : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, লেখক ও বামপন্থী রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এদেশের স্বাধীন বিবেকের এক প্রতীক বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। রোববার তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে এক শোকবার্তায় তিনি এ মন্তব্য করেন। রোববার সকাল ১০টার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলে ৯৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত বদরুদ্দীন উমর ভোগছিলেন।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, মরহুম বদরুদ্দিন উমর বারবার রাজরোষে পড়া সত্ত্বেও তিনি তার আদর্শ বাস্তবায়নে ছিলেন আপোষহীনভাবে স্থির। কোন ভীতি বা হুমকি তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি তার কর্তব্যকর্ম থেকে। স্বৈরতন্ত্রকে উপেক্ষা করে তিনি তার স্বাধীন মতামত প্রকাশে কখনোই কুন্ঠিত হননি। তিনি এদেশে ছিলেন স্বাধীন বিবেকের এক প্রতীক।

বদরুদ্দীন উমরের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনীতির পথিকৃত, লেখক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দিন উমরের জীবনাবসানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও আমি গভীরভাবে মর্মাহত। স্বাধীনচেতা, নির্ভিক কন্ঠস্বরের এই বুদ্ধিজীবীর এই মূহুর্তে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া জনমনে হতাশার সৃষ্টি করেছে। তারেক রহমান বলেন, জনগণের সম্মান ও নিদারুন বেদনাকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি এবং সেটিকে প্রতিবাদের ভাষায় মূর্ত করতে পারতেন মরহুম বদরুদ্দিন উমর। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা এবং সকল স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রয়াত বদরুদ্দিন উমরের চিন্তা ও লেখনিসহ সক্রিয় তৎপরতা ছিল অবিস্মরণীয়। জাতির নানা ক্রান্তিকালে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পর্ব নিয়ে তার গবেষণাধর্মী গ্রন্থ সমূহ এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে পাঠক সমাজের নিকট সমধিক সমাদৃত।

অপর এক শোকবার্তায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমৃত্যু তিনি (বদরুদ্দীন উমর) জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করেছেন ও কলম ধরেছেন। রাজনীতির দুর্নীতিকরণের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক জলন্ত প্রতিবাদ। বিদ্যমান রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে তার মতো নির্ভিক মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীর বেঁচে থাকা খুব জরুরী ছিল।

বদরুদ্দীন উমরের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে তিনি বলেন, লেখক, গবেষক, বামধারার বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক বদরুদ্দিন উমরের মৃত্যুতে আমি বেদনাহত। কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের এবং শোষণ মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণা ছিল তার লেখনি। ইতিহাসের পরিক্রমায় নানা উত্থান-পতনের ঘটনা নিয়ে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। আজীবন বাম প্রগতিশীল রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট মরহুম বদরুদ্দিন উমর সহজ, সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছেন নিজ আদর্শে অবিচল থেকে। কখনোই স্বৈরশাসকের ধমকে নিরব দর্শক হয়ে থাকেননি বরং তিনি তার কথা ও লেখনিতে অন্যায় ও অবিচারের স্বৈরতন্ত্রের মূলে প্রচন্ড শক্তিতে কুঠারঘাত করেছেন। প্রয়াত বদরুদ্দীন উমরে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান বিএনপি মহাসচিব।

আজ শ্রদ্ধা জানাতে বদরুদ্দীনের মরদেহ নেওয়া হবে শহীদ মিনারে : প্রথিতযশা লেখক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমরের মরদেহ আজ সোমবার সকাল দশটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। কিছু সময়ের জন্য তার মরদেহ সেখানে রাখা হবে, যেন সকলে শেষবারের মতন তাকে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। গতকাল বিষয়টি নিশ্চিত করেন মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম। তিনি জানান, বদরুদ্দীন উমরের মরদেহ বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর বড় মেয়ে বিদেশে রয়েছেন। তিনি ফেরার পর আগামীকাল বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তাঁর প্রথম জানাজা হওয়ার কথা রয়েছে। জানাজা শেষে তাঁকে জুরাইন কবরস্থানে সমাহিত করা হবে।

শেখ হাসিনার মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন বদরুদ্দীন উমর : ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালে চলমান মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন সদ্য প্রয়াত বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর।’ গতকাল রবিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রসিকিউটর তামিম বলেন, ‘প্রয়াত বদরুদ্দীন উমর শেখ হাসিনার মামলায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন। তিনি ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য প্রদান করতে পারলেন না, তবে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে উনি ওনার সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৯(২) ধারা অনুযায়ী কোনও সাক্ষী যদি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সাক্ষ্য দিয়ে মারা যান, সেক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের আবেদনে ট্রাইব্যুনাল তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া সাক্ষ্যকে গ্রহণ করতে পারেন। তবে সে বিষয়ে প্রসিকিউশন আবেদন করবে কিনা সে বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর সিদ্ধান্ত নেবেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত