
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে মোট ২৮টি পদের ২৩টিতেই জিতেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল। সংগঠনটির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর ফলাফল নিয়ে চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ করেছেন রাজনীতিবিদ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার ডাকসুতে ছাত্রশিবির প্যানেলের বিজয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়েছে।
ডাকসু নির্বাচনের প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ডাকসুতে ২০১৯ সালের পর দেশের মানুষ একটি অসাধারণ নির্বাচন এবং অবাক করা ফলাফল দেখল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পেছনে সুসংগঠিত পরিকল্পনা, ভোট বিভাজন ও পুরোনো ছাত্ররাজনীতির প্রভাব থাকায় ঐতিহাসিক বিজয় পেয়েছে ছাত্রশিবির। তবে, এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া বড় পদের প্রধানতম প্রার্থীরা প্রায় সবাই জুলাইয়ের ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন। লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম সংস্কৃতি আর গেস্টরুম নির্যাতনের ফ্যাসিবাদী কালচার আর ফিরবে না-এই প্রত্যয়ে ভরা করে শিক্ষার্থীরা শিবিরের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন। কারণ, অতীতে ছাত্ররাজনীতির পাণ্ডারা বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে, এবার শিবিরকে শিক্ষার্থীরা একচেটিয়া ভোট দিয়ে পুরনো রাজনীতির সংস্কৃতি প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত দুই দশকে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-কোচিং সেন্টারে ছাত্রশিবির প্রকাশ্য বা গোপনে আর্থিক-সাংগঠনিক যে বিনিয়োগ করেছে তারই সুফল তারা ডাকসুতে পেয়েছে। নারীদের মধ্য থেকে ইসলামী ছাত্রশিবির ভালো ভোট টেনেছে। সেখানেও গোপনে ও প্রকাশ্যে তাদের সাংগঠনিক-আর্থিক শক্তি এই ভোট টানতে সহায়তা করেছে। জামায়াতে ইসলামীর আর্থিক সামর্থ্য ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলার শক্তিও এখানে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে বলে অনুমান করা যায়। বামরাজনীতির অনৈক্য বা সমমনা নিজেদের মধ্যে ভোটের কাটাকুটি ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেলকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এছাড়া যারা অনাবাসিক ভোটার তাদের কিছু ভোট স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন, সেখানে হল ভিত্তিক সংগঠনের নেতা ও সমর্থকদের ভোটের সংখ্যা বেশি থাকায় ছাত্রশিবির এগিয়ে গেছে। পাশাপাশি ইসলামী ছাত্রশিবির বহুসময় ধরে ডাকসু নির্বাচনের জন্য সাংগঠনিক-আর্থিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে তাদের কর্মসূচি চালিয়ে গেছে। ফলে তারা অন্যসব সংগঠনের চাইতে প্রস্তুতিতে এগিয়ে থেকেছে। ভোটের ফলাফলে তার ছাপ পড়েছে।
ডাকসু নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদসহ ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টি পদেই জয়ী হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রার্থীরা। বাকি পদগুলোতে স্বতন্ত্র ও বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের প্যানেল থেকে জয়ী হন। তবে একটি পদেও জিততে পারেননি ছাত্রদলসহ বাকি প্যানেলের প্রার্থীরা। ভিপি পদে বিজয়ী হয়েছেন আবু সাদিক কায়েম, জিএস পদে এস এম ফরহাদ এবং এজিএস পদে মুহা. মহিউদ্দীন খান। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে সানজিদা আহমেদ তন্বি এবং সমাজসেবা সম্পাদক-যুবাইর বিন নেছারী জয়ী হয়েছেন। সদস্য পদে ১৩টির মধ্যে ১১টিতে জয়ী হয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের সদস্যরা। একটিতে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। অন্যটিতে জয়ী বামণ্ডসমর্থিত প্রার্থী। ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে জয়ী হলেন- সাবিকুন নাহার তামান্না, সর্ব মিত্র চাকমা, আফসানা আক্তার, রায়হান উদ্দীন, তাজিনুর রহমান, ইমরান হোসাইন, মিফতাহুল হোসাইন আল-মারুফ, মো. রাইসুল ইসলাম, শাহীনুর রহমান, আনাস ইবনে মুনির এবং মো. বেলাল হোসেন অপু। এছাড়া সাত বাম ছাত্র সংগঠনের প্যানেল ?প্রতিরোধ পর্ষদ থেকে জয়ী হয়েছেন হেমা চাকমা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন উম্মা উসওয়াতুন রাফিয়া।
বুধবার জামায়াতের প্রচার বিভাগ থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘এই নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, আমি তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তারা তাদের দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে আমি আশা করি।’
গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, এই প্রজন্ম দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি দেখতে চায় না। এই যে এক বছর চাঁদাবাজি, দখলদারিত্বের রাজনীতি এবং ক্ষমতায় যাবার আগেই ক্ষমতায়িত হয়ে গেছে- এরকম হাবভাব করা, এই রাজনীতি দেখতে চায় না। অতএব তারা নতুন কিছু করতে চায়।
ডাকসুর সাবেক ভিপি মান্না বলেন, অপমানিত ছাত্রসমাজ নতুন কিছু করে দেখিয়েছে। এই গেস্টরুম কালচার, বড় ভাইদের সালাম করা, প্রোটোকল দেওয়া, ভর্তি পরীক্ষা না হলেও তারপরে ভর্তি হতে পারবে, পরীক্ষা দিতে না দেওয়া- সব দেখে অপমানিত ছাত্রসমাজ। তারা মনে করেছে, এই জীবনের মধ্যে আমরা সাহস দেখাব।
দুই দুই বারের ডাকসুর ভিপি পদে জয়লাভ করা মান্না বলেন, ডাকসুতে যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে মানুষ মনে করবে ভালো নির্বাচন তো সম্ভব। এই জন্য শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ দেন তিনি। জানি এই নির্বাচনের ফলাফল অনেকের জন্য রীতিমতো হতবাক, কেউ কেউ অবশ্য বলছেন যে এটার মধ্যে জাল জালিয়াতি আছে, কিন্তু তারপরে ফলাফলটা ঘোষণা হয়েছে এবং যারা বিক্ষোভ করছিলেন তারা এখন আপাতত প্রশমিত বলে মনে হচ্ছে।
গতকাল গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও ধৈর্য ও কৌশলের সঙ্গে প্রাণবন্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বিবৃতিতে নুর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, নতুন নেতৃত্ব জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে সব ছাত্রসংগঠনকে সম্পৃক্ত করে একটি ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতির পথ খুলে দেবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হবে শিক্ষা, গবেষণা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, গান-কবিতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কেন্দ্রস্থল।
ডাকসুতে জামায়াত-শিবিরের বিজয় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে পোস্টে সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি লিখেছেন, ?‘ডাকসুতে জামাত-শিবিরের বিজয় কোনো ছেলের হাতের মোয়া ছিল না। ৫০ বছরের অবিরত এবং ধারাবাহিক মেহনত, গত ১৫ বছরের কৌশল এবং গত একবছরের সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা যা পেয়েছে, তা অনিবার্য ছিল! জামাত-শিবিরের প্রতিপক্ষের অতি আত্মবিশ্বাস, অহমিকা এবং কৌশল বিনিয়োগ মেহনতের ঘাটতির কারণে যে পরাজয়ের সূচনা হলো, তা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে তা কেবল আল্লাহই জানেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি এম এম জসিম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক বছরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের শিক্ষার্থীবান্ধব কাজ করার কথা ছিল, সেখান থেকে পিছিয়ে ছিল। অন্যদিকে শিবির গত এক বছরে নামে-বেনামে বিভিন্ন হলে ডিবেটিং ক্লাব, টিএসসি কেন্দ্রিক সামাজিক ও সাংস্কৃতি সংগঠন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। শিবির ক্যাম্পাসে ভালো কাজ করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশিয়ে গেছে। তারা, শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করতে পেরেছে যে- তারা সুন্দর ক্যাম্পাস উপহার দেবেন।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে ডাকসুতে শিবির যেসব ইশতেহার দিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে আগামী নির্বাচনেও শিবির ভাল করবে, আর যদি ইশতেহার বাস্তবায়ন না করতে পারে তাহলে ডাকসুতে শিবির জয়ী হতে পারবে না। এবার ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হিসেবে শিক্ষার্থীরা শিবিরকে ভোট দেন বলে মনে করেন ঢাবির সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি।