
এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে হংকংয়ের মুখোমুখি হওয়ার আগে নিজেদের প্রস্তুত করতে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে নেপালে গিয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল দল। লক্ষ্য পূরণ করে ভালো অভিজ্ঞতা নিয়েই দেশে ফেরার কথা ছিল লাল সবুজ দলের। কিন্তু উল্টো ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতাই সঙ্গী হয়েছে হাভিয়ের কাবরেরার শিষ্যদের। প্রাণক্ষয়ী সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর সর্বপরি বিদ্রোহের আগুনে জ্বলছে নেপাল। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই পড়েছিলেন জামাল ভূঁইয়ারা। তাদের টিম হোটেলেও আক্রমণের চেষ্টা হয়েছিল। তবে হোটেল কর্তৃপক্ষের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় হামলাকারীদের নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়। তবে অজানা শঙ্কা নিয়েই হোটেলে সময় কেটেছে খেলোয়াড়দের।
অবশেষে ভয়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান। বিদ্রোহের আগুনে নেপাল সরকারের পতনে কাঠমান্ডুতে আটকেপড়া জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা অবশেষে ফিরেছেন দেশে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে কাঠমান্ডুর ক্রাউন ইম্পিরিয়াল হোটেল থেকে বের হয়ে স্থানীয় সময় পৌনে ৯টায় বিমানবন্দরে পৌঁছায় বাংলাদেশ দল। সেখানে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে বেলা ২টা ৫৫ মিনিটে দেশের বিমান ধরেন ফুটবলাররা। বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলা এ কে খন্দকার ঘাঁটিতে জামাল ভূঁইয়াদের বহনকারী বিশেষ বিমানটি অবতরণ করেছে। তাদের সঙ্গে একই বিমানে ফিরেছেন ক্রীড়া সাংবাদিকরাও। জাতীয় দলের সঙ্গে নেপালে গিয়েছিলেন সংবাদ কর্মী ওমর রুবেল। কুর্মিটোলায় অবতরণের পর যুগান্তরের এই ক্রীড়া সাংবাদিক বলেন, ‘সে এক ভয়াবহ, বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা। চারিদিকে হামলা, ভাঙচুর আর আগুনে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ভয় তাড়া করেছে আমাদের। দেশে ফিরে মনে হচ্ছে- নতুন জীবন পেলাম আমরা। মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।
দলের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছিলেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। বিমানবাহিনী তাদের ফেইসবুকে জামালদের ফেরা নিয়ে লিখেছে, ‘নেপালে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে অবস্থানরত বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সি-১৩০বি বিশেষ ফ্লাইটের মাধ্যমে সফলভাবে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছে।’
এর আগে গত মঙ্গলবার নেপালে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতায় রূপ নিলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন। বিক্ষোভকারী ব্যক্তিরা রাজনীতিবিদদের বাড়িঘরে ভাঙচুর চালান। সরকারি ভবন ও পার্লামেন্টে আগুন ধরিয়ে দেন। দুই দিনের সহিংসতায় ৩০ জন নিহত হন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয় ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। পরের দিন বুধবার সন্ধ্যায় কাঠমান্ডু বিমানবন্দর সচল হয়। বাফুফে তখনই জাতীয় দলসহ সেখানে কাভার করতে যাওয়া সাংবাদিকদের ফেরানোর উদ্যোগ নেয়। সরকার, ফেডারেশন ও কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সম্মিলিত প্রয়াসে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলাদেশ দলের ফ্লাইট নিশ্চিত হয়। টিম হোটেল ছেড়ে স্থানীয় সময় ৯টার দিকে বাংলাদেশ দল বিমানবন্দরে পৌঁছায়। সেখানে প্রায় ছয় ঘণ্টা অপেক্ষার পর স্থানীয় সময় আড়াইটার পর উড্ডয়ন করে বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমান। সেই বিমান ঢাকায় অবতরণ করে বিকাল ৪.৪০ মিনিটে। বাংলাদেশ-নেপাল ম্যাচ কাভার করতে ঢাকা থেকে ১৫ জনের বেশি সাংবাদিক কাঠমান্ডু গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ দলের মতো তারাও ভোগান্তিতে পড়েছিলেন। সেই সাংবাদিকরাও ফিরেছেন দলের সঙ্গে।
জাতীয় দল ৩ সেপ্টেম্বর নেপালে গিয়েছিল দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে। ৬ সেপ্টেম্বর প্রথম ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হয়। দ্বিতীয় ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল ৯ সেপ্টেম্বর। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি আর দুর্নীতির প্রতিবাদে জেন-জি আন্দোলনে সহিংসতা শুরু হলে দ্বিতীয় ম্যাচ বাতিল হয়ে যায়। গত মঙ্গলবার পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে ২২ জনের মৃত্যুর পর নেপালের প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। দেশটির পার্লামেন্ট ভবন ও মন্ত্রীদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। নেপালের বিভিন্ন অংশে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে কারফিউ জারি করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় বিমানবন্দর। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ফুটবল দল কাঠমান্ডুর হোটেলে আটকা পড়ে। তাদের ফিরিয়ে আনতে বিমানের একটি ফ্লাইট মঙ্গলবার কাঠমান্ডু গেলেও ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অনুকূল পরিস্থিতি না থাকায় নামার অনুমতি পায়নি। পরে সেটি ঢাকায় ফিরে আসে।
এরপর থেকে হোটেলবন্দি ছিলেন ফুটবলাররা। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), কাঠমান্ডুর বাংলাদেশ দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকারের সম্মিলিত চেষ্টায় ফুটবল দলকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশ দল চেয়েছিল গত রাতেই ফিরতে। ঢাকা থেকে বিশেষ ফ্লাইটের চেষ্টা চালানো হলেও সেটা সম্ভব হয়নি। অবশেষে গতকাল একটি বিশেষ ফ্লাইটে কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় ফিরল খেলোয়াড়, কোচ, স্টাফদের ৩২ জনের বহর। সঙ্গে ফিরেছেন আটকে পড়া সাংবাদিকরাও।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল নেপালে খেলতে গিয়ে ভূমিকম্পের কবলে পড়ে হোটেলে আটকা পড়েছিল। সেবার টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দল। ভয়াবহ ভূমিকম্পে আটকাপড়া মেয়েদের উদ্ধার করে বিশেষ বিমানে ঢাকায় আনা হয়। ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল স্বাগতিক নেপাল।