
আওয়ামী স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাঠে ছিলেন না, মামলা-হামলা কিংবা নির্যাতনের শিকার হননি, পালিয়েও থাকতে হয়নি, বরং বিগত দিনে তাল মিলিয়ে চলেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে, তারাই এখন বিএনপির দাপুটে ‘হর্তাকর্তা’। তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন নব্য বিএনপি নামধারী অনেকে, যারা কখনও বিএনপিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তারাই এখন নানা জায়গায় দাপটের সঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসব হাইব্রিডদের আবির্ভাব ঘটায় বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরা এখন মূল্যায়িত হচ্ছেন না। অভিযোগ, দলটির হাইকমান্ডও ত্যাগী নেতাকর্মীদের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না। এতে দিনদিন কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ক্ষোভ বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে দলীয় রাজনীতিতে। ফলশ্রুতিতে দিনদিন দলের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা যায়, দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সড়কের অলিগলিতে এখন তাদের ব্যানার, পোস্টার শোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন নেতার বাসাবাড়ি কিংবা অফিসে এসব নেতার পদচারণাও বাড়ছে। ভিড় করছেন বিভিন্ন লবিং-তদবির নিয়ে। অন্যদিকে, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে যেসব নেতাকর্মী রাজপথে ছিলেন, মামলা-হামলায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, ঘরছাড়া হয়েছেন, তারা এখন ‘অসহায়’।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, ওয়ান-ইলেভেন থেকে শুরু করে আওয়ামী সরকারের আমলে সীমাহীন নির্যাতনের মধ্য দিয়ে দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে থেকেছেন। অনেকে গুম হয়েছেন, অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। দলের এমন কোনো নেতাকর্মী নেই, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। অনেকের বিরুদ্ধে মামলার তিন সেঞ্চুরিও পার হয়েছে বিগত দিনে। এসব মামলায় সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে তাদের। অনেকের সহায়-সম্পদ দখল করা হয়েছে, অনেককে ঘরবাড়ি ছাড়া হতে হয়েছে। তবে যেসব নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করেছেন, তারা ছিলেন বহাল তবিয়তে। ওই সময়ে তারা নিজেদের মতো করে ব্যবসা করেছেন, নিরাপদে থেকেছেন। কোনো নির্যাতন তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। তারা সব সময়ই বিভিন্ন লবিং-তদবিরে পদ বাগিয়েছেন। আর এখন দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই দলের সামনের সারিতে চলে এসেছেন। এটা শুধু বিএনপির নেতাকর্মীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। দল-সমর্থিত বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যেও বিস্তার করেছে।
সাংবাদিক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, শিক্ষক থেকে শুরু করে অন্যান্য পেশার মধ্যেও দৌরাত্ম্য বেড়েছে বিগত দিনের নিষ্ক্রিয়দের। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে একসময় পুরো দলকে এর চরম খেসারত দিতে হবে বলে শঙ্কিত বিএনপির নেতারা। তারা বলছেন, বিএনপির সুদিনের সম্ভাবনায় এখন অনেক হাইব্রিড নেতা জুটতে শুরু করেছেন, আওয়ামী লীগের অনেক সুবিধাভোগী খোলস পরিবর্তন করে বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও বিভিন্ন কায়দা-কানুন করে দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে আখের গোছানোর চেষ্টা করছেন বলে তারা জানতে পারছেন। এসব নেতাকর্মীই দেশের বিভিন্ন জায়গায় অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। চতুর প্রকৃতির হাইব্রিড নেতারা সুযোগ বুঝে সটকে পড়লেও ধরা খাচ্ছেন বিএনপির কতিপয় নেতাকর্মী। যাদের অপকর্মের দায়ে বহিষ্কার হতে হচ্ছে।
আলমগীর হোসাইন নামের ত্যাগী একজন ছাত্রনেতার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমরা স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের জন্য জীবন বাজি রেখে রাজপথে আন্দোলন করেছি। হামলা-মামলার শিকার হয়েছি। নিজের বাড়িতে থাকতে পারিনি। গুম ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। তবু দলকে ভালোবাসি বলে কখনও পিছপা হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেক হাইব্রিড নেতার জন্ম হয়েছে। তারা নানাভাবে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। আবার তাদের দল মূল্যায়ন করছে। আমরা যারা জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছি, সর্বস্ব হারিয়েছি। তারা এখন নানাভাবে অবমূল্যায়িত হচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে দলের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হবে। আমি হাইকমান্ডের প্রতি আহ্বান জানাব- হাইব্রিডদের দলে স্থান না দিয়ে ত্যাগীদের দলে মূল্যায়ন করুন, তাহলে দলের কোনো সুনাম নষ্ট হবে না। সূত্রমতে, বিগত দিনের আন্দোলনে কোথাও না থাকলে এখন হাইব্রিড কিছু লোক হয়েছেন সবচেয়ে কট্টর নেতা। তারাই এখন বড় নেতা সেজেছেন। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার, সরবরাহকারীর কার্যক্রম। কাকে কোন পদে বসাবেন, কাকে সরাবেন তাও তারা নিয়ন্ত্রণ করছেন। সেখানে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়ার ঘটনাও ঘটছে।
দলটির সিনিয়র এক নেতা বলেন, হাইব্রিড নেতাদের বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছেন। এরই মধ্যে দল থেকে নেতাকর্মীকে সতর্ক করা হয়েছে। দলে যোগদান অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এরপরও বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অনেকে অনেক অপকর্ম করছেন। যাদের সঙ্গে বিএনপির ন্যূনতম কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এসব বিষয়ে তারা যথেষ্ট সজাগ রয়েছেন। বিএনপির দুর্দিনে যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, পরিশ্রম করেছেন- দল তাদের মূল্যায়ন করবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ বিষয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীকে বিভিন্ন সময়ে আশ্বস্ত করেছেন।
কয়েকজন ত্যাগী নেতার সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, আমরা বিএনপিকে ভালোবাসি। আমরা বিগত দিনে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ছিলাম। এখন আমরা অনেকটা অবহেলিত। যারা বিগত দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে ছিল না, তারাই এখন বড় বড় নেতা বনে গেছে।
অধিকাংশ সিনিয়র নেতারা তাদেরই বেশি মূল্যায়ন করছে। তবে, আমাদের অহংকার তারেক রহমান দেশে আসলে আশা করি, সব সমাধান হয়ে যাবে। তিনি আমাদের অবশ্যই মূল্যায়ন করবে।
এদিকে, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভরাডুবি হয়েছে। দলের ছাত্র সংগঠনের এমন শোচনীয় পরাজয়ে হতভম্ব বিএনপি। পরাজয়ের জন্য ন্যূনতম প্রস্তুত ছিলেন না নেতারা। যদিও অনেক প্রার্থী নির্বাচনি কারচুপি ও ফলাফল প্রভাবিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। এখন সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনে ধরাশায়ী হওয়ার কারণ খুঁজছে।
কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভরাডুবির অন্যতম কারণ হলো- ভাগাভাগির হল কমিটি, হল কমিটির প্রার্থীদের ক্যাম্পাসে পরিচিতি নেই, বিএনপির মাত্র একজন নেতার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে প্রার্থী তালিকা প্রণয়ন, সাবেক ছাত্রনেতা ও বিএনপিপন্থি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার কারণেই এমন ফলাফল হয়েছে।
এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদল নেতাদের ধারাবাহিক যোগাযোগ না থাকাও তাদের সঙ্গে দূরত্বের বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর বাইরে গ্রুপিং ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সম্পাদকীয় তো দূরের কথা, একজন সদস্য প্রার্থীও বিজয়ী হয়ে বের হয়ে আসতে পারেননি বলেও মনে করছেন তারা। এ ছাড়া অল্প সময়ে প্যানেল গঠন করায় বিভিন্ন গ্রুপকে এক প্ল্যাটফরমে আনতে পারেনি ছাত্রদল। নির্বাচনে দলের প্রত্যেক স্তরের নেতাকর্মী আর সমর্থকদের পাশে টানতেও পারেনি। শুধুমাত্র প্রার্থীদের ব্যক্তি ইমেজকে কেন্দ্র করে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চেয়েছে সংগঠনটি। শিক্ষক এবং নারী ভোটার কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল খুবই দুর্বল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ও ঢাবি ছাত্রদলের নেতারা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের হল কমিটিসহ সব জায়গায় যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। এর পরিবর্তে তরুণদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থাৎ আমার লোক না হলে তাকে কোনো পদ-পদবি দেওয়া যাবে না। অথচ নির্বাচনের দিন হল কমিটির নেতাদেরও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর বাইরে পারস্পরিক বিভেদ এবং দ্বন্দ্বও ফল বিপর্যয়ের কারণ বলেও মনে করছেন তারা।
ওদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতার দিকনির্দেশনায় ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা কাজ করছেন। এই নেতা নির্বাচনের দিন সাবেক ছাত্রদলের কোনো নেতার ফোনও রিসিভ করেননি এবং কোনো নির্দেশনা দেননি। ডাকসুর ছাত্রদলের সাবেক নেতা এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নেতাদেরও নির্বাচনের দিন তিনি কোনো দিকনির্দেশনা দেননি।