
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো আবারও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা, এর মাধ্যমে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। তাদের দাবি, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দলগুলো। মূলত সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজের বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৬ ধারা অনুসরণের কথা বলেছেন। গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের মধ্যাহ্ন বিরতিতে ব্রিফিংয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। অবশ্য বিএনপি ও জামায়াত নেতারা এ নিয়ে মন্তব্য করেননি।
বিএনপি : জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যু নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, আমরা আলোচনার টেবিলে আছি। সমাধানের জন্য, এক জায়গায় যাওয়ার জন্য, প্রতিদিন ইনোভেটিভ আইডিয়াস বা জাতির পক্ষে সমাধানের জন্য প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছি। এখন যদি এই আলোচনার টেবিলে সমাধান হয়, আমি আশা করি হবে ইনশাআল্লাহ। গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা যে কোনো অসাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে আমরা বন্ধ করতে পারব এবং যেটা আমি আশঙ্কা প্রকাশ করি এবং অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছে, যদি এটা আমরা ঝুলিয়ে রাখি, যদি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে আমরা অনিশ্চিত করি, বাধাগ্রস্ত করি বা বিলম্বিত করি। তাহলে সেইটার বেনিফিশিয়ারি কে হবে? পতিত ফ্যাসিবাদ হবে। সেটার বেনিফিশিয়ারি কি হবে? কোনো রকমের কোনো অসাংবিধানিক শক্তি হবে। তাহলে সেটার পরিণতি কি হবে- এই জাতি অনেকবার সে পরিণতি ভোগ করেছে, সেই পরিণতিকে আমরা আবার আহ্বান জানাতে পারি না। সুতরাং আমরা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা আগাই এবং একটা সমাধানের দিকে যাই।
অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, এক বছর হয়ে গেল ইন্টারিম গভর্মেন্টের, সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় সাংবিধানিক নিয়মে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নামে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাদের শপথ গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতিকে যে মতামত দিয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতির রেফারেন্স অনুসারে পাঠানোর প্রেক্ষিতে সেটা কি অকার্যকর হয়ে গেল? এটা কি জুডিশিয়ারিতে অথবা সুপ্রিম কোর্টে এখনও পর্যন্ত এর বিপরীতে কোনো সিদ্ধান্ত এসেছে? আসে নাই। সুতরাং এই ব্যাপারে প্রশ্ন তোলাটা এটা আমি মনে করি অনেকটা রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো। এটার কোন লিগালিটি নাই।
তিনি বলেন, কনস্টিটিউশনাল অর্ডার ইস্যু করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে, এখনই সেটা কার্যকর হবে, সেটা কি আগামীকালকে বা পরশু চ্যালেঞ্জ হবে না? তো সেরকম একটা খারাপ নজির কি আমরা জাতির সামনে উত্থাপন করতে পারি? অবশ্যই পারি না। কিন্তু আমরা সমাধান চাই। সমাধান চাই বলেই আমরা কিছু বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। যেগুলো বিবেচনায় নেওয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাব। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার চলছে, এর বাইরে একটি দল পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে, এটি কীভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেতা বলেন, রাজনৈতিক দলের দাবি নিয়ে আন্দোলন করার অধিকার আছে। পিআর বিষয়টি নির্বাচনে জনগণের কাছে নিয়ে যাক। এন্ড অফ দি ডে জনগণই তো ডিসাইড করবে, কী সিদ্ধান্ত নেবে? আমরা রাস্তায় কে কয়টা জনসভা করলাম, কে কয়টা মিছিল দিলাম, তার উপর কি পিআর নির্ধারিত হবে? সেটার জন্য তো একটা প্রক্রিয়া আলোচনার টেবিলে আসতে হবে। সে আলোচনার টেবিলে আমরা আছি। সেটা এখনও অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, পিআরের মাধ্যমে সবসময় একটা অনিশ্চিত সরকারব্যবস্থা থাকে এবং ঝুলন্ত পার্লামেন্ট থাকে এবং কখনও মেজরিটির ভিত্তিতে সরকার গঠন করার মতো মেজরিটি পাওয়া যায় না এবং সেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার ব্যবস্থায় সংসদব্যবস্থায় তখন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা যায় না। তার উদাহরণ তো আমাদের পার্শ্ববর্তী অন্য একটা দেশে এরইমধ্যে আমরা দেখেছি। আমরা সেরকম একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অঙ্গীকার করতে পারি না।
তিনি বলেন, জনগণ হচ্ছে সুপ্রিম অথরিটি। তারপরও এ দেশের জনগণ তো মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে তো গণতন্ত্রকে এস্টাবলিশ করেছে। এ দেশের জনগণ বারবার গণতন্ত্রহীন অবস্থা থেকে গণতন্ত্রকে উদ্ধার করেছে। বারবার এই দেশে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিভিন্ন সময় সেখান থেকে এই জাতি উদ্ধার হয়েছে। সালাহউদ্দিন বলেন, নেক্সট পার্লামেন্টে কিছু মৌলিকবিষয় এমেন্ডেড হবে যেগুলো তো আমরা এখন সম্মত হয়েছি। ঐকমত্য কমিশনের সনদের মধ্যে সেই বিষয়গুলো পরিবর্তনে অবশ্যই রেফারেন্ডাম নিতে হবে।
জামায়াত : জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জুলাই সনদের আইনিভিত্তি এখন ১৮ কোটি মানুষের দাবি। এই সনদটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জারি করা হোক এবং প্রয়োজনে গণভোটের আয়োজন করা হোক। তবে, এই গণভোট অবশ্যই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই হতে হবে, নির্বাচনের পরে নয়। গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক বৈঠক শেষে তিনি এসব কথা বলেন। মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, যদি সরকার জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি করে, তাহলে জনগণ স্বাভাবিকভাবেই আবারও রাস্তায় নেমে আসবে। মাওলানা রফিকুল ইসলাম ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির উদাহরণ টেনে বলেন, তৎকালীন সময়ে দলগুলোর ঐকমত্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতায় থাকা দলগুলো সেটি যথাসময়ে বাস্তবায়ন করেনি। পরে আন্দোলনের মাধ্যমেই তা সংবিধানে যুক্ত হয়। তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের মাধ্যমে, যা ছিল আদালতের রায়ে প্রভাবিত একটি সিদ্ধান্ত। তাই, বিচার বিভাগকে আবার বিতর্কের মুখে না ফেলে সংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে জামায়াত।
জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, ঐকমত্য কমিশন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে ৪টি বিকল্প নিয়ে কাজ করেছে, যার মধ্যে কমিশন সংবিধানিক আদেশের প্রস্তাবটি সমর্থন করেছে। এ আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের ২২টি আর্টিকেল বাস্তবায়িত হতে পারে। এটি আইনিভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি। হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করার এখতিয়ার সংসদের নেই এবং এ ধরনের পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই গণভোটের প্রয়োজন হয়।
তিনি বলেন, অতীতে ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে যে গণভোট হয়েছিল, সেটি ছিল নির্বাচন পরবর্তী একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী সরকার এসেছে এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েই জুলাই সনদের আইনিভিত্তি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগকে এই বিতর্কের মধ্যে জড়ানো উচিত নয়, কারণ এতে আদালত প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং দেশের জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়।
হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, জামায়াতে ইসলামী জনগণের অভিপ্রায়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, কারণ জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন। তিনি বলেন, জুলাই সনদের যে আদর্শ ও চেতনা, তা বাস্তবায়ন হওয়া উচিত এবং যারা এই আদর্শের পথে হাঁটবে না, জনগণ তাদের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।
তিনি ডাকসু নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর বিপুল ভোটে জয়লাভের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এটি প্রমাণ করে যে এদেশের তরুণ সমাজ ও জনগণ নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা চায় এবং জুলাই বিপ্লবের যোদ্ধাদের পক্ষেই রয়েছে। সবশেষে তিনি বলেন, যদি গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদের বিষয়ে জনগণের মতামত চাওয়া হয়, তবে জনগণ দেশের স্বার্থে, নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এই সনদের পক্ষেই রায় দেবে। তিনি আরো বলেন, জনগণ যদি জুলাই সনদের পক্ষে না থাকে, তবে আমরা সেই রায়ও মেনে নেব।
এনসিপি : জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে আমরা ১০৬ ধারা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত চাই না। আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই। তা এই সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনার পর আমাদের মতামত জানাব।’
এবি পার্টি : আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের প্রস্তাবকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। বিশেষ করে আমরা আগে থেকেই গণভোটের কথা বলেছি। সেটি নির্বাচনের আগে হোক বা পরে হোক। গণভোট হতে হবে। জুলাই সনদের আইনিভিত্তি না হলে হবে না। কারণ, যেখানে এখনই বিষয়টি নিয়ে মতবিরোধ, সেখানে পরবর্তী সরকার করবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।’ তিনি মনে করেন, নির্বাচন যত দেরি হবে- বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, সংবিধান পরিবর্তন, সংস্কার, সংশোধন, নতুন করে লেখা বা সংবিধান বাতিলের চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতে। আমরা ঐক্যবদ্ধ মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণয়ন করেছি, যদিও কয়েকটি বিষয়ে কারও কারও ভিন্নমত আছে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে কী হবে, তার সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ।
তিনি আরও বলেন, কমিশনের প্রস্তাবে জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদ রেফারেন্স আকারে উল্লেখ করায় কিছু রাজনৈতিক দল ও নেতা সনদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে মঞ্জু প্রশ্ন রেখে বলেন, আজ যারা সনদ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, কাল তারা সংসদে গিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবেন এবং তখন কি এটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না- তার নিশ্চয়তা কোথায়?
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার সানী আব্দুল হক বলেন, সংবিধানে এটা নেই- ওটা নেই বলে সংস্কার সম্ভব নয়- এমন ধারণা অভ্যুত্থান প্রবণতারই বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের অবস্থান থেকে নমনীয় না হয়, তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে, যা জাতিকে গভীর সংকটে ফেলবে। তিনি আরও যোগ করেন, জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা এখন জরুরি। অন্যথায় গণভোটের পথ ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না।
এলডিপি : লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির মহাসচিব অ্যাডভোকেট রেদোয়ান আহমেদ বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত বিষয়ে কথা বলেছেন। নতুন করে জুলাই ঘোষণার ২২ নম্বর অনুচ্ছেদ সামনে আনা হয়েছে। অথচ এর কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে ১০৬ অনুযায়ী আদালতের নির্দেশনার ভিত্তিতে। এটি আমাদের সংবিধানকে পাশ কাটানোর চেষ্টা। এটার পক্ষে আমরা নেই। পরবর্তী নির্বাচন হবে, আমরা সেটাই চাই। নতুন কোনো আদেশের বিষয় চাই না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেসব প্রস্তাব সাংবিধানিক না, তা সরকার আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে। সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদে কার্যকর হতে পারে।’
গণঅধিকার পরিষদ : গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারও বিভাজনের দিকে উসকে দিয়েছে। সরকার নিজেরা সিদ্ধান্ত না নিয়ে আবারও দলগুলোর দিকে বল ঠেলে দিয়েছে। দায় নিতে চাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশের প্রস্তাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এটি সরকারের কথা নয়। এ নিয়ে হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আরও আলোচনা হবে।’ তিন প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘যদি জনগণ এটি না মানে তাহলে কী হবে। আওয়ামী লীগের যারা ভোট দেবে তাদের ঠেকানোও কঠিন।’ রাশেদ খান বলেন, ‘সর্বসম্মতিক্রমে যা বাস্তবায়ন হয়, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। সরকার আবার দলগুলোর মধ্যে বিভাজন উসকে দিচ্ছে। সরকার দায় নিতে চায় না।’ তিনি মনে করেন, এভাবে সময় বাড়তে থাকলে আওয়ামী লীগের ফিরে আসা সহজ হবে। তাই সবাইকে ছাড় দিতে হবে। সংস্কার ও বিচার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত। বিষয়গুলো সরকারকে দেখতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলন : গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেছেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের মতামতে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। বলা হয়েছে জুলাই ঘোষণার ২২-এর ধারা অনুযায়ী এটি করা হবে। অথচ ২৫-এর ধারা অনুযায়ী এটি স্ববিরোধিতা। আবার গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। আমরা মনে করি, বিদ্যমান সরকার যেভাবে ১০৬ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী ক্ষমতায় আছেন, সে রকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কি না। এরপর একটি অধ্যাদেশ হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এমন কোনো পথ নেওয়া উচিত নয়, যাতে বোঝা যায় তা কোনো কর্তৃত্বের মাধ্যমে হচ্ছে। এ বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া দরকার।’
জেএসডি : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘আইনিভিত্তি না দিয়ে করলে সনদ বাস্তবায়ন কঠিন হবে। এক্ষেত্রে ১০৬ অনুসরণ করা যেতে পারে। তবে এর সুরক্ষার জন্য যে পদ্ধতির কথাই বলা হোক আমরা সেটির পক্ষে।’
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ : জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি বলেন, ‘সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদে পাস করতে হবে। আর একমত হওয়া বিষয়গুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে করতে হবে। তাছাড়াও সংবিধানের ১০৬ অনুযায়ী প্রয়োজনে সনদ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। আমরা মনে করি, গণভোট সমস্যা আরও বাড়াবে।’
বাসদ (মার্কসবাদী) : বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, ‘গণভোটের বিষয়টি সংবিধানে নেই। এটি নির্বাচিত সংসদ করবে। আমরা সনদ বাস্তবায়ন চাই। তবে সুরক্ষার জন্য এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যেন কেউ চ্যালেঞ্জ না করতে না পারে।’
ভাসানী জনশক্তি পার্টি : ভাসানী জনশক্তি পার্টির মহাসচিব আবু ইউসুফ সেলিম বলেন, ‘সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জুলাই ঘোষণার ২২ ধারা ২৫-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা মনে করি, ১০৬ ধারা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট মতামত দেবেন। আর পরবর্তী সংসদ তা কার্যকর করবে।’
এদিকে তৃতীয় ধাপের সংলাপের তৃতীয় দিনে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের বিষয় উত্থাপন করেছে কমিশন। তার মধ্যে রয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটের মাধ্যমে জনগণের বৈধতা নেওয়া। এর আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত রোববার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে তারা জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ ধারা অনুযায়ী সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের সংবিধান সম্পর্কিত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে পরামর্শ দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই সনদ ২০২৫-এ মূল সংস্কারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ (সিও) জারি করতে পারে। এ সাংবিধানিক আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। বিশেষজ্ঞরা আরও প্রস্তাব করেছেন, সাংবিধানিক আদেশকে একটি গণভোটে উপস্থাপন করা যেতে পারে, যা আগামী সাধারণ নির্বাচনের একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। সাংবিধানিক আদেশে গণভোটের বিধানও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যদি সাংবিধানিক আদেশ জনগণের অনুমোদন পায় গণভোটের মাধ্যমে, তবে তা প্রণয়ন তারিখ থেকেই বৈধ বলে গণ্য হবে।
আগামী রোববারের মধ্যেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায় কমিশন : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে ২১ সেপ্টেম্বরের (রোববার) মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায় কমিশন। তবে ব্যর্থ হলে তা ২ অক্টোবরের পরে চলে যেতে পারে। গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার শুরুতেই এ কথা বলেন তিনি। এসময় অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে চারটি পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আলী রীয়াজ বলেন, বিশেষজ্ঞরা অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, কমিশনের মেয়াদ এক মাস বাড়ানো হয়েছে। কমিশন কোনো অবস্থাতেই এক মাস সময় নিয়ে এই আলোচনা অব্যাহত রাখতে উৎসাহী নয়। আমরা মনে করি না যে আগামী এক মাস ধরে এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। আমরা খুব দ্রুত একটা ঐকমত্যের জায়গায় উপনীত হতে পারব। ঐকমত্য কমিশনের এই সহ-সভাপতি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে চায় কমিশন। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে যাবেন এবং ২ অক্টোবর তিনি দেশে ফিরে আসবেন। আশাবাদ ব্যক্ত করে আলী রীয়াজ বলেন, গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশ এই দুটো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ভিন্নমত ছিল তা কাটিয়ে উঠে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে দ্রুতই আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করে সরকার। এতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি ও সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে সহ-সভাপতি করা হয়।