ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা

ফেব্রুয়ারির নির্বাচন গণতন্ত্রে নতুন যুগের সূচনা করবে

* জাতিসংঘে সিনিয়র বিশ্বনেতাদের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক * সামাজিক উদ্ভাবন বিষয়ক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা * থেয়ারওয়ার্ল্ডের ‘আনলক বিগ চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ লাভ
ফেব্রুয়ারির নির্বাচন গণতন্ত্রে নতুন যুগের সূচনা করবে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আসন্ন ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হবে একটি ভিত্তি স্থাপনকারী নির্বাচন, যা দেশের গণতন্ত্রে নতুন যুগের সূচনা করবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে রয়েছে এবং আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গত মঙ্গলবার প্যারিসের মেয়র আনে হিদালগো নিউইয়র্কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে হোটেলে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ সব কথা বলেন।

প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ তথ্য জানান। সৌজন্য এ সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম, খেলাধুলা ও অলিম্পিকে সামাজিক ব্যবসার ভূমিকা এবং বৈশ্বিক শরণার্থী সংকট, বিশেষ করে রোহিঙ্গা মানবিক সংকট নিয়ে দুই নেতা বিস্তারিত আলোচনা করেন। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, প্যারিস ২০২৪ অলিম্পিককে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সামাজিক ব্যবসার আসরে রূপান্তরিত করতে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ভবিষ্যতের সব অলিম্পিক গেমস, লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকসহ কার্বন-নিউট্রাল করার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। প্যারিসের মেয়র আনে হিদালগো এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমি আপনার নেতৃত্বের প্রশংসা করি। আপনি অসাধারণ কাজ করছেন।

দুই নেতা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থানরত প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীর মানবিক সহায়তার জন্য তহবিল বাড়ানোর জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মেয়র হিদালগো বিশ্বব্যাপী শরণার্থী শিবিরে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের আহ্বান জানান এবং আশা প্রকাশ করেন যে রোহিঙ্গারা একদিন নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবেন।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানান, আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘ রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করছে, যা বিশ্বের দৃষ্টি এই দীর্ঘস্থায়ী শরণার্থী সংকটের দিকে পুনর্নির্দেশ করবে।

তিনি মেয়র হিদালগোকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।

জাতিসংঘে সিনিয়র বিশ্বনেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক: জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের ফাঁকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত মঙ্গলবার বিশ্বসংস্থাটির সদর দপ্তরে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন।

তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী, নেদারল্যান্ডসের রানি ম্যাক্সিমা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক, চিলির প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান ও উরুগুয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন।

এসব বৈঠকে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা করেন।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন হবে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য। তিনি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি আশা করেন।

প্রধানমন্ত্রী আলবানিজ অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটির অবদানের প্রশংসা করেন এবং কয়েক বছর আগে ভাষা শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার স্মৃতি তুলে ধরেন।

নেদারল্যান্ডসের রানি ম্যাক্সিমার সঙ্গে বৈঠকে তারা স্বাস্থ্যবীমা সম্প্রসারণ, জীবন ও স্বাস্থ্যবীমা, দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। অধ্যাপক ইউনূস মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবার জন্য ঋণ সহজলভ্য করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এবং ডিজিটাল স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের শীর্ষ চিকিৎসকদের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন।

তিনি বৈশ্বিক ঔষধশিল্প পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসায় ঔষধ প্রস্তুতকারকরা উৎপাদিত টিকা সর্বদা সুলভ রাখবে।’

রানি ম্যাক্সিমাকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান অধ্যাপক ইউনূস। বৈঠকে প্রিন্সেস অব অরেঞ্জ রাজকুমারী কাথারিনা-আমালিয়াও উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. তেদরস আধানোম গেব্রিয়াসিসের সঙ্গে বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস যৌথ অগ্রাধিকার ও সাম্প্রতিক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেন।

দিনের শেষ পর্যায়ে তিনি ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’ এবং সামাজিক উদ্ভাবনে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা বিষয়ক দুটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

সামাজিক উদ্ভাবন বিষয়ক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা : অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত সামাজিক উদ্ভাবন বিষয়ক বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এই বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ‘সামাজিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থায়ন কার্যকর করা।’ এতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বৈঠকের আয়োজন করে। এতে সামাজিক উদ্ভাবন ও অর্থায়নের নতুন পথ ও সুযোগ নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা ধারণা বিনিময় ও সহযোগিতার ওপর জোর দেন। থেয়ারওয়ার্ল্ডের ‘আনলক বিগ চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন মুহাম্মদ ইউনূস : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস থেয়ারওয়ার্ল্ডের ‘আনলক বিগ চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন।

স্থানীয় সময় গত সোমবার নিউইয়র্কের একটি হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ ইউনূসকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। শিক্ষা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাঁর পথপ্রদর্শক ভূমিকা এবং মানবকল্যাণে আজীবন প্রতিশ্রুতির স্বীকৃতিস্বরূপ এই সম্মাননা পেলেন তিনি।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত থেয়ারওয়ার্ল্ডের বার্ষিক উচ্চপর্যায়ের গ্লোবাল এডুকেশন ডিনারে নোবেল শান্তি পুরস্কারবিজয়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূসকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হলো।

শিশুদের জন্য নিবেদিত আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা থেয়ারওয়ার্ল্ড বিশ্বব্যাপী শিক্ষার সংকট নিরসন ও নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনা বিকাশে কাজ করছে।

অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন জাতিসংঘের বৈশ্বিক শিক্ষাবিষয়ক বিশেষ দূত ও যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এবং থেয়ারওয়ার্ল্ডের চেয়ার ও গ্লোবাল বিজনেস কোয়ালিশন ফর এডুকেশনের নির্বাহী চেয়ার সারা ব্রাউন। অনুষ্ঠানে শিক্ষার রূপান্তরমূলক শক্তিকে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়।

মুহাম্মদ ইউনূসের পাশাপাশি জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডিকেও সম্মাননা দেওয়া হয়।

তবে দারিদ্র্য দূরীকরণে মাইক্রোক্রেডিট কার্যক্রম ও শিক্ষাকে তার কেন্দ্রীয় অংশে অন্তর্ভুক্ত করার আজীবন সংগ্রামের কারণে মুহাম্মদ ইউনূসের স্বীকৃতি বেশি গুরুত্ব পায়।

গর্ডন ব্রাউন পুরস্কার প্রদানকালে বলেন, গত ৫০ বছরে বেসরকারি খাতে কোনো প্রকল্প মানুষের দারিদ্র্যমুক্তিতে গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্যোগের মতো কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। তিনি মুহাম্মদ ইউনূসকে বিশ্বব্যাপী এক পথপ্রদর্শক হিসেবে অভিহিত করেন।

পুরস্কার গ্রহণকালে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো ঋণও একটি মৌলিক মানবাধিকার। যদি আর্থিক ব্যবস্থার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত হয়, তবে পৃথিবীতে কেউ আর গরিব থাকবে না।

মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি মাইক্রোক্রেডিটের প্যাকেজে শিক্ষাকে যুক্ত এবং নারীদের সহায়তা করেছি, যাতে তারা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারে।’ মুহাম্মদ ইউনূস আর্থিক ক্ষমতায়ন ও শিক্ষার আন্তসম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মাইক্রোক্রেডিটের সুযোগ নিয়ে বহু নারী তাঁদের পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করেছেন। সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছেন।

শিক্ষার প্রচলিত ধ্যানধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ছোটবেলা থেকেই শিশুদের সৃজনশীলতা ও উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলার শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। একজন শিশুর শেখা উচিত কীভাবে উদ্যোক্তা হওয়া যায়। মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসাকে মানবকল্যাণের শক্তি হিসেবে ব্যবহার করার শিক্ষা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত এমন এক স্থান, যেখানে মানবসমস্যার সমাধান শুধু উৎসাহিতই নয়, প্রত্যাশিতও হবে। মানবসমাজের সব সমস্যারই ব্যবসায়িক সমাধান সম্ভব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত