
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেছেন, এটা স্পষ্ট যে ব্যালট পেপার ছাপানোর স্থান বা সংখ্যা সুষ্ঠু নির্বাচনকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করে না। কারণ ব্যালট পেপারকে ভোটের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করতে একাধিক ধাপ সম্পন্ন করতে হয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে যে অভিযোগ পেয়েছি, প্রত্যেকটির জন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। ৪৮টি অভিযোগের কমনগুলো জবাব দিয়েছি। ১৬টি অভিযোগ ৬৯ ধারায় ব্যক্তি পর্যায়ে অফিসিয়াল চিঠির মাধ্যমে নিশ্চিত করেছি। এরপরও আমরা লক্ষ্য করেছি, নির্বাচনকে পদ্ধতিগত নানারকম প্রশ্ন তুলে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রবণতা চলছে। বিশেষ করে সর্বশেষ কয়েক সপ্তাহ পরে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা চলছে। গতকাল রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
লিখিত বক্তব্যে ঢাবি উপাচার্য বলেন, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে নিয়ম মেনে একটি অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে ব্যালট পেপার ছাপানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভোটার ও প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় দ্রুততম সময়ে নির্ধারিত পরিমাণ ব্যালট ছাপানোর স্বার্থে মূল ভেন্ডরের সঙ্গে আলোচনা করে একই টেন্ডারের অধীনে আরেকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে নীলক্ষেতে ব্যালট ছাপানোর বিষয়টি সহযোগী ভেন্ডর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেনি।
‘সহযোগী ভেন্ডরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নীলক্ষেতে ২২ রিম কাগজ ব্যবহার করে ৮৮ হাজার ব্যালট ছাপানো হয়। প্রিন্টিং, কাটিং, প্রি-স্ক্যান প্রক্রিয়া শেষে সেগুলোর মধ্যে ৮৬ হাজার ২৪৩টি ব্যালট প্যাকেটে ভরে সিলগালা করে সরবরাহযোগ্য হয়। অবশিষ্ট ব্যালট প্রচলিত নিয়মে ধ্বংস করা হয়। ভেন্ডর জানায়, কাটিং শেষে ব্যালটগুলো তাদের মূল অফিসে নিয়ে গিয়ে প্রি-স্ক্যান ও পরবর্তী কার্যক্রম সম্পন্ন করে নির্ধারিত পরিমাণে প্যাকেটে ভরে সিলগালা করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে সরবরাহ করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী তারা পুরো প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। তবে ব্যস্ততার কারণে নীলক্ষেতে ছাপানোর বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাতে ভুল হয়েছে বলে তারা স্বীকার করে।’ উপাচার্য আরও বলেন, ব্যালট পেপার শুধু ছাপালেই তা ভোটের জন্য ব্যবহারযোগ্য হয় না। ছাপানোর পর নির্দিষ্ট মাপে কাটিং, নিরাপত্তা কোড আরোপ, ওএমআর মেশিনে প্রি-স্ক্যান, চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তার সিল ও স্বাক্ষর এবং সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার স্বাক্ষর—এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরই তা ভোট গ্রহণের উপযোগী হয়। এসব ধাপ নিশ্চিত করেই সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি জানান, কার্যাদেশ অনুযায়ী ২ লাখ ৩৯ হাজার ২৪৪টি ব্যালট ভোটের জন্য প্রস্তুত করা হয়। মোট ভোটার ছিলেন ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন; প্রত্যেকে ৬টি ব্যালট পান। ভোট দেন ২৯ হাজার ৮২১ জন ভোটার। ব্যবহার করা হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯২৬টি ব্যালট। অবশিষ্ট থাকে ৬০ হাজার ৩১৮টি ব্যালট।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিসিটিভি ফুটেজ এবং ভোটার তালিকা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, কোনো প্রার্থী যদি সুনির্দিষ্ট সময় বা ঘটনার ফুটেজ দেখতে চান, তাহলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত স্থানে বিশেষজ্ঞ বা মনোনীত ব্যক্তির উপস্থিতিতে তা দেখা যাবে।
ভোটারদের স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা বিষয়ে উপাচার্য বলেন, কোনো প্রার্থী নির্দিষ্ট ও যৌক্তিক কারণে কোনো ভোটারের স্বাক্ষর পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করলে কর্তৃপক্ষ মনোনীত বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে তা দেখা সম্ভব।
ডাকসু নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ সাদা দলের দ্বিচারিতা: ইউটিএল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন নিজেদের তত্ত্বাবধানে হওয়ার পরও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। এটাকে দ্বিচারিতা বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংক (ইউটিএল)। গত শনিবার বিকেলে ডাকসু ভবনের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ইউটিএলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. আতাউর রহমান বিশ্বাস বলেন, আমার ডাকসু নির্বাচন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ছোটখাটো কিছু ত্রুটি ছিল। তবে নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারে কিংবা ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে- পুরো নির্বাচনে এমন কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি ইউটিএলের নজরে আসেনি। তিনি বলেন, আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার দুই সপ্তাহ পর কিছু ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষকদের সংগঠন নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা শুরু করেছে। কিছু বক্তব্য ও বিবৃতি ইউটিএলের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা মনে করি, এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর স্বাধীন রায়কে অসম্মান এবং গণতান্ত্রিক অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি সুপরিকল্পিত প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়।
অধ্যাপক ড. মো. আতাউর রহমান বিশ্বাস আরও বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল ডাকসু নির্বাচন নিয়ে এক হতাশাজনক বিবৃতি দিয়েছে। জুলাই পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোতে সাদা দল নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিভিন্ন অনুষদের ডিন এবং ১৮টি হলের মধ্যে ১৬টি হলের প্রভোস্টরা সরাসরি সাদা দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এছাড়া ডাকসু নির্বাচনের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশনের ১০ সদস্যের মধ্যে ৮ জনই সাদা দলকে প্রতিনিধিত্ব করেন।
এসময় তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, নির্বাচন তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব যখন সাদা দলের শিক্ষকদের হাতে ছিল, তখন নিজেদের বিবৃতিতে দাবি করা নির্বাচনে জালিয়াতি ও অনিয়ম প্রসঙ্গ দ্বিচারিতা ও দ্বিমুখী আচরণের পর্যায়ে পড়েছে। এতে করে বিবৃতি দেওয়া শিক্ষকদের নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
এসময় ইউটিএলের পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাবনা পেশ করা হয়। সেগুলো হলো- ১. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উত্থাপিত অযৌক্তিক প্রশ্নের সুরাহা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের পর কোনো ধরনের নিপীড়ন কিংবা তাদের ম্যান্ডেট কেড়ে নেওয়ার মত কর্মকাণ্ড বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। ২. ঢাবি সাদা দলের শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে পরিচালিত নির্বাচনকে সাদা দলের প্যাডে বিবৃতি দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, যা মোটেই কাম্য নয়। এই ধরনের বিবৃতি প্রত্যাহার করতে হবে। ৩. ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় এরই মধ্যে দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। এমন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যেসব তৎপরতা দেখা যাচ্ছে সেগুলোর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে।