
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং জুলাই ঐক্যের ফাটলের কারণে তৈরি রাজনৈতিক বিরোধের প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে কি না, এ নিয়ে নিরাপত্তা ও নির্বাচন বিশ্লেষকদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছেন, চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘সন্তোষজনক’ অবস্থায় আনতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। একইসঙ্গে জুলাই ঐক্যে ফাটল দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে একযোগে ৩০০ সংসদীয় আসনে নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা রয়ে গেছে।
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভোটের মাঠে বড় পরিসরে থাকছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল। সেখানে জামায়াত পিআর পদ্ধতি, এনসিপির জুলাই সনদের ভিত্তিতে এবং বিএনপি বিদ্যমান অবস্থায় নির্বাচন চাইছে। যা নিয়ে জুলাই ঐক্যের ভেতরে এক ধরনের ফাটল তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় পেশীশক্তি বনাম নিরপেক্ষতার চ্যালেঞ্জকেও বড় করে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সংসদ নির্বাচন না হওয়ার মতো অবস্থায় নেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এই দেশে এর চেয়ে ভালো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কবে ছিল? রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে ঐক্য থাকলে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বলেন, সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন সহনশীল হতে হবে, না হলে পরিবেশ খারাপ হয়ে গেলে তো নির্বাচনই বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য প্রত্যেককে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। অন্তত ঝুঁকিপূর্ণ ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানো দরকার। প্রয়োজনে সমন্বিত নির্বাচনি নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন (১০ মাসে) সারা দেশে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৫৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ডাকাতির ৬১০টি, চুরির ৭৩১০টি, দস্যুবৃত্তির ১৫২৬টি, খুনের ৩৫৫৪টি, দাঙ্গার ৯৭টি, নারী ও শিশু নির্যাতনের ১২ হাজার ৭২৬টি, অপহরণের ৮১৯টি, ধর্ষণের ৪ হাজার ১০৫টি, পুলিশ আক্রান্তের ঘটনায় ৪৭৯টি, অন্য কারণে রুজুকৃত ৬৮ হাজার ৬৮০টি, অস্ত্র আইনে ১ হাজার ৪৩৬টি, মাদকদ্রব্যের ৩৮ হাজার ১৭৬টি এবং চোরাচালানের ১ হাজার ৮২০টি মামলা। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, জমি দখল ও মব ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ কাটেনি।
‘ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও জামিনসংক্রান্ত তথ্য’ শিরোনামে পুলিশের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৩ মাসে এমন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৪৪ হাজার ৪৭২। তাদের মধ্যে ৩২ হাজার ৩৭১ জন জামিন পেয়েছেন। অর্থাৎ মোট প্রায় ৭৩ শতাংশ আসামির জামিন হয়েছে। পুলিশের ভাষ্যমতে, আওয়ামী লীগ পতনের পর বেশকিছু থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করায় পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়াসহ লজিস্টিকস ঘাটতিতে স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। তবে, অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে পুলিশের মনোবল স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ‘পালস সার্ভে ৩’-এর ফলাফলে দেখা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ‘মব’ (দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা) সহিংসতা নিয়ে উৎকণ্ঠিত। নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠা ৬১ শতাংশ মানুষ, যাদের ৫৬ শতাংশ পুরুষ আর ৬৬ শতাংশ নারী। পোশাকের জন্য রাস্তাঘাটে হয়রানি নিয়ে উৎকণ্ঠিত ৬৭ শতাংশ মানুষ। তাদের ৬৩ শতাংশ পুরুষ আর ৭১ শতাংশ নারী। আগস্ট রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নজর দেওয়ার আহ্বান বলেন, মানুষ হয়তো মনে করছে অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দল কেউই তাদের উদ্বেগগুলো নিয়ে চিন্তিত নয়। হয়তো এ কারণেই ভোটের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীন মানুষের সংখ্যা বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র, অবৈধ অস্ত্র, মব ভায়োলেন্স, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রপাগান্ডা ও দেশ-বিদেশে পলাতক কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা। সেইসঙ্গে পেশাদারিত্ব কাজে লাগিয়ে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণকে আস্থায় জায়গায় আনার সুযোগ পাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
গত ২৫ আগস্ট সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা করেছে সরকার। এতে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার দেওয়া হবে। একটা শর্ট গান কিংবা পিস্তল উদ্ধার করতে পারলে ৫০ হাজার টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হবে। চায়না রাইফেল ও এসএমজি উদ্ধার করে দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে ১ লাখ টাকা। এলএমজির ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এছাড়া প্রতি রাউন্ড গুলির জন্য ৫০০ টাকা দেওয়া হবে।
আসন্ন নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্র বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখছেন সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশকে জোর দিতে হবে। নির্বাচনে এসব অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা বিঘেœর বড় কারণ হয়ে দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত পুলিশের সোর্স বাড়াতে হবে। যেসব জায়গায় রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা আছে, সেখানে পাবলিক অর্ডার সিচুয়েশন ঠিক রাখতে হবে। সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জাতীয় নির্বাচনের মতো বড় ধরনের আয়োজন সম্পন্নের জন্য পুলিশ এখনও পুরোপুরি সক্ষম নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর শাহরিয়া আফরিন। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশ যে অবস্থায় চলে গিয়েছিল, এখন সেখান থেকে অনেকটাই উঠে এসেছে। কিন্তু এখনও দেশে যেভাবে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই হচ্ছে তাতে এটি মনে করার কোনো কারণ নেই, পুলিশ পুরোপুরি সক্ষম অবস্থানে চলে গেছে। যে অবস্থানে থেকে নির্বাচনে ভালো ভূমিকা পালন করা সম্ভব। মব ভায়োলেন্স, মিডিয়া গুজব এবং অবৈধ অস্ত্র নির্বাচনের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন প্রফেসর শাহরিয়া আফরিন।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কারণ যাদের অর্থ ও পেশিশক্তি আছে, তারাই নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করবে। যার মধ্যদিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তি ফের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠ হবে। জনগণ ভোটাধিকার হারাবেন।
ড. তৌহিদুল হক বলেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অনেক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি এখনও উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি ‘মব’ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ, প্রতিদিনের অপরাধের চিত্রগুলো মানুষকে ভয়ার্ত পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থার প্রয়োগ-সংক্রান্ত ঘাটতিও মানুষকে স্বস্তি বা আশ্বস্ত করতে পারছে না। সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, ছাত্র-জনতা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যের ভিত্তিতে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত ঘটানো হয়। এখন রাজনৈতিক স্বার্থে সেই জুলাই ঐক্যের ভেতরে ‘মতানৈক্য’ দেখা দিয়েছে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে জুলাই ঐক্যের ভেদাভেদ দূর করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এক বছরে বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, অথচ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। এর পেছনে কারও কারও অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তাদের কাছে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এক ধরনের আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন ড. তৌহিদুল হক।