
ক্রীড়া সংগঠকদের দিয়েই দেশের ক্রীড়াঙ্গন পরিচালিত হতো এক সময়। অনেক সময় দু-একজন এমপি-মন্ত্রী কিংবা সরকারি আমলারাও সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। তবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে সরাসরি এবং ব্যাপকহারে রাজনীতিকরণ করা হয়, গত সরকারের আমলে। সব ক্রীড়া সংস্থা-ফেডারেশনে দলীয় ব্যক্তি মনোনয়ন কিংবা নির্বাচিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদের বেশিরভাগ সদস্য ছিলেন দলীয়। গত বছর ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিসিবির দলীয় পরিচালকরা অত্মগোপনে চলে যান। এরপর শুরু হয় পরিবর্তন। নতুন করে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া হয় বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদে। যদিও সরকারের চাওয়ায় মাঝে বিসিবির শীর্ষ পদে পরিবর্তন আসে। এরপর ঘোষণা করা হয় বিসিবি নির্বাচনের তফসিল। ধারণা করা হচ্ছিল, আগামী ৬ অক্টোবরের নির্বাচনে অনেকটা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিচালনা পর্ষদ হবে বোর্ডের। কিন্তু সে আশায় ছেদ পড়ে যখন দেখা যায় ঘুরে ফিরে আবারও রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।
একদিকে বর্তমান বিসিবি সৃভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। যাকে সরাসরি সমর্থন দিচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। অপরদিকে রয়েছেন সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায় বিএনপি। দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার ছেলে তামিমের প্যানেলে মনোনয়ন জমা দেন। দুই পক্ষ একে অপরের প্রতি পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তোলেন। এমনকি নির্বাচনে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগও ওঠে। এরপর শুরু হয় সমঝোতার চেষ্টা। এ নিয়ে গত কয়েক দিন চলে নাটকের পর নাটক। শেষ পর্যন্ত সমঝোতা প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। গুঞ্জন রটে এক পক্ষের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর।
অবশেষে সেই গুঞ্জনই সত্যি হল। তামিম ইকবাল আসন্ন বিসিবি পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। গতকাল বুধবার তিনি নিজের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। সরকারপক্ষের হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তামিমের পুরো প্যানেল নির্বাচন বর্জন করছে।
এর আগে গত মঙ্গলবার বিসিবির সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ৬ অক্টোবরের বিসিবি নির্বাচনে ১৫টি বিতর্কিত ক্লাবের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ জারি করে। এই ১৫ ক্লাব থেকে প্রায় সব ভোটই তামিম ইকবালের প্যানেলের পাওয়ার কথা। পূজার ছুটিতে আদালত বন্ধ থাকায় নির্বাচনের আগে আপিলের সুযোগও না থাকায় এমন সময়ের রিট আবেদনকে অন্য চোখে দেখা হচ্ছিলো। এদিকে গত রাতেই আভাস পাওয়া যায় ঢাকার অন্তত ১০ থেকে ১২টি ক্লাব ভোট বর্জন করতে চলেছে। বিসিবি নির্বাচনের শুরু থেকেই সরকারের নানান পর্যায়ের হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান। জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলোর কাউন্সিলর ঠিক করতেও নানান বিতর্কিত ঘটনা সামনে এসেছে। শেষ মুহূর্তে ঢাকার ক্লাবগুলোর উপরও হস্তক্ষেপ দেখা গেলে নির্বাচনে সরকারঘনিষ্ঠদের জয় অনেকটা অনুমিতও হয়ে যাচ্ছিল।
এই অবস্থায় নির্বাচনে থাকার প্রয়োজন মনে করছেন না তামিম। গতকাল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমিসহ প্রায় ১৪ থেকে ১৫ জন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছি। প্রত্যাহারের কারণটা খুবই স্পষ্ট। আমার কাছে মনে হয় না বিস্তারিতভাবে আপনাদের কিছু বলার দরকার আছে। নির্বাচন কোন দিকে যাচ্ছে, এই জিনিসটা এখন পরিষ্কার। যখন যেমন মনে হচ্ছে, যখন যা মনে হচ্ছে, তখন তা করা হচ্ছে। এটা আসলেই নির্বাচন নয়, ক্রিকেটের সঙ্গে এই জিনিসটা কোনো দিক থেকেই মানায় না।’
তামিমসহ এখন পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের ছেলে সাইদ ইবরাহিম, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছেলে ইসরাফিল খসরু, মির্জা আব্বাসের ছেলে মির্জা ইয়াসির আব্বাসসহ ১৫ জন। তামিম দাবি করেছেন, অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীই নির্বাচন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। ‘যারা নাম প্রত্যাহার করেছেন, তারা সবাই হেভিওয়েট, তাদের ভোটব্যাংকও শক্তিশালী। এটা একটা প্রতিবাদ। দিন শেষে এই নোংরামির অংশ হয়ে আমরা থাকতে পারব না। বাংলাদেশ ক্রিকেট এটা ডিজার্ভ করে না। যারা এভাবে নির্বাচন করতে চান, তারা করতে পারেন। তবে আজ ক্রিকেট শতভাগ হেরে গেছে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আপনারা বড় গলায় বলেন বাংলাদেশে ফিক্সিং বন্ধ করা লাগবে, আগে নির্বাচনের ফিক্সিং বন্ধ করার চিন্তা করেন। পরে ক্রিকেটের ফিক্সিং বন্ধ করার চিন্তা করেন। এই নির্বাচন বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য একটা কালো দাগ হয়ে থাকল।’
এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, ইন্দিরা রোড ক্লাবের হয়ে পরিচালক পদে নির্বাচন করতে চাওয়া রফিকুল ইসলামও। তিনিও গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা শেষ পর্যন্ত কেন টেকেনি? রফিকুল বলেছেন, ‘আমরা একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন চেয়েছিলাম। ২০০৫ সালে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন দেখেছিলাম। আমরা তেমন একটা নির্বাচন চেয়েছিলাম। সমঝোতার কথাটা হাওয়ায় উড়ে বেরিয়েছে, কোনো সঠিক তথ্য ছিল না।
তামিম ইকবাল ছাড়া সরে দাঁড়ানো অপর প্রার্থীরা হলেন- রফিকুল ইসলাম বাবু (ইন্দিরা ক্রীড়াচক্র), মাসুদুজ্জামান (মোহামেডান), সাঈদ ইব্রাহীম আহমেদ (ফেয়ার ফাইটার্স), মির হেলাল (চট্টগাম জেলা), সৈয়দ বুরহান হোসেন পাপ্পু (তেজগাঁও ক্রিকেট একাডেমি), ইসরাফিল খসরু (এক্সিউম ক্রিকেটার্স), সাব্বির আহমেদ রুবেল (প্রগতি সেবা সংঘ), তৌহিদ তারেক (পাবনা), অসিফ রাব্বানী (শাইনপুকুর), সিরাজ উদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর (ক্যাটাগরি-৩), ইয়াসির আব্বাস (আজাদ স্পোর্টিং), ফাহিম সিনহা (সুর্যতরুণ), সাইফুল ইসলাম সপু (গুপিবাগ ফ্রেন্ডস) ও ওমর শরীফ মোহাম্মদ ইমরান (বাংলাদেশ বয়েজ)।
সব মিলিয়ে, বিসিবি নির্বাচন নিয়ে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, তা এখন এক নতুন মোড়ে পৌঁছেছে। কাউন্সিলরদের মনোনয়ন ঘিরে হাইকোর্টের রায়, দুদকের তদন্তর সুপারিশ এবং ১৫ ক্লাব সংগঠকের কাউন্সিলরশীপ বাতিল চেয়ে কোর্টে রিটের জেড়ে প্রার্থীদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত-সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচনি পরিস্থিতি আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
তফসিল অনুযায়ী আগামী ৬ অক্টোবর বিসিবি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বিসিবির গঠনতন্ত্র অনুসারে পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন মূলত তিনটি ক্যাটাগরিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বিসিবির ২৫ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হবে কাউন্সিলরদের ভোটের মাধ্যমে। বিসিবির গঠনতন্ত্রে ১৭১ জন কাউন্সিলরের ৭৬ জনই ঢাকার ক্লাব থেকে আসেন। আবার বোর্ডের ২৫ সদস্যের মধ্যে ১২ জন আসেন ক্লাব ক্রিকেট থেকে। বিভাগীয় ও আঞ্চলিক পর্যায় থেকে আসেন ১০ জন। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ক্যাটাগরিতে আসেন একজন এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) কোটায় ২ জন আসেন। এরপর নির্বাচিত পরিচালকদের ভোটে বিসিবির সভাপতি বেছে নেওয়া হবে।