
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা এবার নিজেরাই ৩০০টি আসনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী। তবে অতীতের মতো এবারও এই দায়িত্ব জেলা প্রশাসকদের হাতে রাখার পক্ষে মত দিচ্ছে প্রশাসন। এ নিয়ে ইসি ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে, যা নির্বাচন পরিচালনার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করছে।
ইসি সূত্র জানায়, রিটার্নিং অফিসাররা ইসির অধীনে দায়িত্ব পালন করেন। তবে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, এই দায়িত্ব সাধারণত জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) উপরেই অর্পণ করা হয়। ফলে বর্তমানে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বও তাদের হাতেই রয়ে গেছে। কিন্তু ডিসিরা সরাসরি সরকারের অধীনস্থ হওয়ায় তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এজন্য অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে নির্বাচন আরও নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আইনে কোনো সংশোধন প্রয়োজন হলে তা করে ইসির অফিসারদের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হোক।
বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মনির হোসেন জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব আমাদের দেওয়া হোক। আশা করি নির্বাচন কমিশন (ইসি) এ বিষয়ে কাজ করবে।
সম্প্রতি ইসি কর্মকর্তাদের সম্মেলনে এ বিষয়ে দ্রুত অধ্যাদেশ জারির আশা প্রকাশ করে ঢাকার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ইউনুচ আলী বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী-কর্মকর্তারা কার কাছে প্রত্যাশা করবে! রিটার্নিং কর্মকর্তা তো আমাদের হাত দিয়েই নিয়োগ হবে। ইসির কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তা হবেন কি হবেন না- কমিশন যদি এ সিদ্ধান্তহীনতা ভোগে তাহলে কোন পরিবর্তনে এগিয়ে যাবে? কমিশনারদের বলব, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং এবং সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের যাত্রা এখন (ইসি) থেকে যেন শুরু হয়। সেইভাবে আমাদের ইসির কর্মকর্তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ইসির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহিয়া আখতার। উপাচার্য ইয়াহিয়া বলেন, সরকার পরিবর্তন হলেও আমলাতন্ত্র পরিবর্তন হয়নি। ইসির যথেষ্ট জনবল আছে। ইসির প্রশিক্ষিত জনবল থাকলেও (নির্বাচনে) আমলাদের নিয়োগ করা হয়। কাজেই ইসির দক্ষ লোকদের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। এখন ডিসিদের দেওয়া হয়। তারা সারা বছর এ নিয়ে কাজ করেন না। আর ইসির কর্মকর্তাদের সেই অভিজ্ঞতা আছে। ডিসি নয়, ইসি কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করা ভালো হবে।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে মাঠপ্রশাসনে রদবদলের পথে হাঁটছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ স্তর জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে এরই মধ্যে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে এরইমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। নির্বাচন কমিশনও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে।
নির্বাচনকালীন ডিসিরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকেন, বিশেষ করে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন তারা। তবে আগামী নির্বাচনে তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে, শেষ পর্যন্ত ডিসিদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে রাখা হলে নির্বাচনে তাদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেটি বিবেচনায় নিয়ে যোগ্যদের নিয়োগ দিচ্ছে সরকার।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছেন এবং এ পর্যন্ত কমিশনের কাজে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা চাপ প্রয়োগ করেননি। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন যাতে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে সে লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কমিশনও জনগণকে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সিইসি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা এ পর্যন্ত আমাদের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করেননি, কোনো সিদ্ধান্তে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি। একবারও বলেননি- এটা এভাবে করুন, ওটা ওভাবে করুন। তার দপ্তর থেকেও কোনো প্রকার প্রভাব আমরা পাইনি। বরং তিনি নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আমি নিজেই তাকে (ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন) বলেছি, আমরা শতভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করছি।’ ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হওয়ার বিষয়ে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে। এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না।
এর আগে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সেই তথ্য জোগাড় করতে নির্বাচন কমিশন সারা দেশের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাছে চিঠি দিয়েছে। মূলত গত তিন নির্বাচনের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ করছে পিবিআই।
ইসির নির্বাচন সহায়তা শাখার উপ-সচিব মনির হোসেনের সই করা চিঠি এরইমধ্যে বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিদের পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ডিএমপির শেরেবাংলা নগর থানার, মামলা নং-১১, জি আর নং-১৫৬/২০২৫খ্রি, ধারা,১২০বি/১০৯/১৭১বি/১৭১ডি/১৭১জি/ ১৭১এইচ/১৭১আই/১২৪৩/৪০৬/৪২০ পেনাল কোড এর সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ঢাকা মেট্রো (উত্তর); ঢাকা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের নাম, ঠিকানা, বাবার নাম, মায়ের নাম, স্থায়ী-বর্তমান ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট নম্বর ও মোবাইল নম্বর ভোটকেন্দ্রভিত্তিক সরবরাহের জন্য অনুরোধ করা হয়। এসব তথ্য জরুরিভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পাঠানো প্রয়োজন। সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ডিসি, ইউএনও থাকেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে। নির্বাচন কর্মকর্তারা থাকেন সহকারী হিসেবে।