ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বিক্ষুব্ধ ঢাকা, গাজার পাশে থাকার শপথ

* গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা আটকের নিন্দায় বাংলাদেশ * ফিলিস্তিন মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা পাশে থাকব, বলল জামায়াত * ফ্লোটিলার কর্মীদের মুক্তির দাবিতে শ্রমিক সংগঠনের সমাবেশ
বিক্ষুব্ধ ঢাকা, গাজার পাশে থাকার শপথ

গাজার জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা বহনকারী আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরাইলি দখলদার বাহিনীর কর্তৃক ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ আটকের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এই কাজ আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ক্ষুধাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ইসরাইলের ব্যবহারের নির্লজ্জ প্রকাশ’। বাংলাদেশ আটক সকল মানবিক সহায়তা কর্মী ও কর্মীদের অবিলম্বে এবং নিঃশর্ত মুক্তি এবং তাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ আরো দাবি করেছে, গাজা এবং পশ্চিম তীরে ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্ব বন্ধ, আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রতি সম্মান, এবং গাজায় গণহত্যা যুদ্ধ এবং মানবিক অবরোধ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা ফ্লোটিলা ইসরাইল অধিকৃত ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে বিশ্বব্যাপী সংহতির প্রতিনিধিত্ব করে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইসরাইলকে অবশ্যই গাজায় তাদের অবাধ প্রবেশাধিকার দিতে হবে। কারণ, সেখানে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী বেসামরিক জনগণকে তাদের জীবন, মর্যাদা এবং জীবিকা নির্বাহের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।’ এই ভয়াবহ দুর্দশা এবং অব্যাহত দুর্ভোগের মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণ ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে অটল সংহতি প্রকাশ করছে।

ফিলিস্তিন মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা পাশে থাকব -জামায়াত : ফিলিস্তিন প্রশ্নে সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিন যতদিন মুক্ত না হয়, যতদিন স্বাধীন না হয়, আমরা ততদিন তাদের পাশে থাকব। আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে। আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। গতকাল শুক্রবার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি। গাজায় ত্রাণ বহনকারী নৌবহর আটকের পর সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ শত শত কর্মীকে আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সে বহরে প্রায় ৪০টি জাহাজ ছিল যার প্রায় সবকটিকে আটকে দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

রফিকুল ইসলাম খান বলেন, নিষ্ঠুর ইসরাইল বাহিনী ফিলিস্তিনের গাজায় একের পর এক গণহত্যা পরিচালনা করছে। এই গণহত্যার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে নারী এবং শিশুরা, এই গণহত্যার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণ। কিন্তু আমরা প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা বিক্ষোভ মিছিল করছি। সারা দুনিয়া এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে, এই গণহত্যার বিরুদ্ধে, এই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, এই শিশু হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে। গতকাল যে ত্রাণবাহী জাহাজের নৃশংসভাবে হামলা পরিচালনা করা হয়েছে, পাঁচশ’র অধিক অধিকার কর্মী, ত্রাণবাহী জাহাজের কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এতে বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে মত দিয়েছে। তিনি বলেন, ফিলিস্তিন ও গাজাকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরও বিশ্বের কিছু শক্তিধর দেশ ছোট্ট ইসরায়েলের পক্ষে অস্ত্র ও সমর্থন দিয়ে এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এই অনৈতিক সহায়তা মানবতার বিরুদ্ধে এক ধরনের খেলায় রূপ নিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি শহীদের রক্তের বিনিময়ে ফিলিস্তিন স্বাধীনতা অর্জন করবে ইনশাআল্লাহ। আমরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাই— অবিলম্বে ইসরায়েলের হাতকে দমন করুন। দখল হওয়া অঞ্চলগুলো দ্রুত মুক্ত ঘোষণা করুন এবং ত্রাণবাহী জাহাজের কর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দিন। বাংলাদেশ সরকারের নিন্দা ও মুক্তির দাবিকেও আমরা স্বাগত জানাই। যতদিন ফিলিস্তিন স্বাধীনতা অর্জন করবে না, ততদিন মুসলমানদের লড়াই সহানুভূতি ও সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন এতে।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখে মানবিক ত্রাণ সহায়তা নিয়ে যাত্রা করা আন্তর্জাতিক নৌবহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলাকে ইসরায়েলি নৌবাহিনী আটক করেছে। নৌবহরটি স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করে এবং পরে ইতালি ও গ্রিস থেকে আরও নৌযান যোগ হয়। এতে ৪০টির বেশি বেসামরিক নৌযান ছিল, যা গাজাবাসীর জন্য খাদ্য, চিকিৎসা সামগ্রী ও অন্যান্য মানবিক সহায়তা বহন করছিল। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নৌ অবরোধ ভাঙা এবং গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে প্রায় ৪৫টি জাহাজে করে গাজার দিকে রওনা দিয়েছিলেন ৫০০ অধিকারকর্মী।

নৌবহরে বিশ্বের ৩৭টিরও বেশি দেশের ৪০০ জনের বেশি অধিকারকর্মী, পার্লামেন্ট সদস্য, চিকিৎসক ও সাংবাদিক ছিলেন। এদের মধ্যে সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গও ছিলেন। ইসরায়েলি নৌবাহিনী বুধবার ভূমধ্যসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায়, গাজা উপকূল থেকে প্রায় ১২০-১২৯ কিলোমিটার দূরে, এই নৌবহরকে বাধা দেয়। ইসরায়েলি সেনারা বেশ কয়েকটি জাহাজ থামিয়ে তাতে উঠে পড়ে এবং নৌবহরের যাত্রীদের আটক করে।

তুরস্ক এই ঘটনাকে ইসরায়েলের জলদস্যুতা আখ্যা দিয়ে এর নিন্দা জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও এই আটকের তীব্র নিন্দা জানিয়ে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছে এবং অবিলম্বে সকল আটককৃতদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।

ফ্লোটিলার মানবাধিকারকর্মীদের মুক্তির দাবিতে শ্রমিক সংগঠনের সমাবেশ : গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার জাহাজ থেকে আটক মানবাধিকারকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি এবং সুমুদ ফ্লোটিলার প্রতি বাংলাদেশের শ্রমজীবীদের সংহতি জানিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে দেশের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) এই প্রতিবাদ সমাবেশ করে।

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ সমাবেশে বলেন, বাংলাদেশসহ ৪৪টি দেশের ৫০০ মানবাধিকারকর্মী সুমুদ ফ্লোটিলা যাত্রায় অংশগ্রহণ করেছেন। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বিধিমালা মেনে মানবাধিকারকর্মীরা গাজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের প্রধানদের সব নিবেদন উপেক্ষা করে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বহরের জাহাজগুলোকে অপহরণ করেছে। মানবাধিকার কর্মীদেরও গ্রেফতার করেছে। তিনি বলেন, জাহাজগুলোতে নেতৃত্বদানকারী তরুণ মানবাধিকার কর্মী, পরিবেশকর্মীরসহ বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন মানবাধিকারকর্মী ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। তাদের মধ্যে অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। তিনি আরও বলেন, আমরা শুধু শ্রমিকদের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামি না। শ্রমিকরা সবসময় ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। ইতালির শ্রমিকরা আন্দোলন করেন। ইতালি থেকে ইসরায়েলে যে অস্ত্র সরবরাহ হয় এবং যেসব জিনিসপত্র রফতানি হয়, তা বন্ধ করে দিয়েছে। সুতরাং, মানবাধিকার আন্দোলন শ্রমিক আন্দোলনের একটি অংশ।

সৈয়দ সুলতান আরও বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন যেখানেই হবে, আমরা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করবো—এটাই হচ্ছে আমাদের অঙ্গীকার। কলোম্বিয়ার একজন নাগরিক ফ্লোটিলায় ছিলেন এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ জন্য কলোম্বিয়া তার ইসরায়েলি দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে এবং চুক্তি ও ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই—অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে মিলে প্রতিবাদ এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর ব্যবস্থা করা হোক—যাতে সবাইকে মুক্ত করে নিয়ে আসা যায়।

বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাকিল আকতার চৌধুরী বলেন, ফিলিস্তিনে যে বর্বরতা চালানো হচ্ছে, এটার সঙ্গে শুধু ইসরায়েলিরা জড়িত নয়, এর সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরাও রয়েছে। তাদেরও বর্বরতার দায় বহন করতে হবে। তিনি বলেন, গাজায় যেভাবে নারী-শিশু নিহত হচ্ছে, এটা চূড়ান্তভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। গোটা পৃথিবী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। সাম্রাজ্যবাদীরা মানবাধিকারের বড় বড় কথা বলে, কিন্তু গাজার এই বর্বরতায় তারা নিশ্চুপ। শাকিল আকতার আরও বলেন, যেসব মানবাধিকারকর্মী ত্রাণ নিয়ে গাজাবাসী ও ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, তাদের আটকে দেওয়া হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আটক মানবাধিকারকর্মীদের ছেড়ে দেওয়া না হলে বাংলাদেশে আমাদের আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের সদস্য সচিব সিকান্দার আলী এবং সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব বুলবুলের সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন- জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি সাইফুজ্জামান বাদশা, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি মাহবুবুল আলম, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ হোসেন, জাতীয় শ্রমিক জোটের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের অর্থ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের যুগ্ম সম্পাদক প্রকাশ দত্ত, শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের সদস্য তৈয়বুর রহমান প্রমুখ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত