ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গাজা যুদ্ধবিরতি

মিসরে আলোচনা, চলছে বর্বরতাও

* নেতানিয়াহুকে ‘প্রতারক ও ভণ্ড’ বলল হামাস, ট্রাম্পের বার্তা * নেতানিয়াহুকে তুরস্কের হুঁশিয়ারি * ‘ইসরাইল যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার জন্য দায়ী’ মনে করেন বেশিরভাগ ইহুদি’ * গাজায় পৌঁছাতে কত সময় লাগবে জানালেন শহিদুল আলম * আটক গ্রেটা থুনবার্গকে নির্যাতন ও ইসরায়েলি পতাকায় চুমু খেতে বাধ্য করার অভিযোগ * গাজা যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইউরোপজুড়ে বিক্ষোভ, লন্ডনে ৫০০ গ্রেপ্তার * ইসরায়েলি বন্দিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে তেলআবিবে বিক্ষোভ
মিসরে আলোচনা, চলছে বর্বরতাও

গাজায় প্রতিদিনই বাড়ছে ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান ও স্থল হামলা। লাগাতার বোমা হামলায় এলাকা পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরিতে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বহু আবাসিক ভবন, স্কুল ও হাসপাতাল। গাজায় মানবিক পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। খাদ্য, পানি ও ওষুধের সংকটে বেঁচে থাকা মানুষগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে।

নেতানিয়াহুকে ‘প্রতারক ও ভণ্ড’ বলল হামাস, ট্রাম্পের বার্তা : ট্রাম্পের নির্দেশনার পরও গাজায় ফের হামলা চালিয়ে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা অব্যাহত রেখেছে বর্বর ইসরাইল। গত রোববার ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বোমাবর্ষণে অন্তত ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। চলমান এই বর্বরতার নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। অভিযোগ তুলে বলেছে, ইসরাইলি যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা কমানোর যে বক্তব্য দিয়েছেন- সেটা নিছকই তার মিথ্যাচার। গতকাল হামাসের বিবৃতির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা মেহের। বিবৃতিতে হামাস বলেছে, ইসরাইলি দখলদার বাহিনী (আইওএফ) গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ অপরাধ ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু আজ সকাল থেকেই হামলায় ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। সংগঠনটি একে ‘রক্তাক্ত উসকানি’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, এটি দখলদার সরকারের প্রতারণা ও ভণ্ডামির বহিঃপ্রকাশ। পাশাপাশি হামাস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আরব ও ইসলামি দেশগুলোকে আবারও আহ্বান জানিয়ে বলেছে, তারা যেন তাদের আইনি ও মানবিক দায়িত্ব পালন করে ফিলিস্তিনি জনগণকে সুরক্ষা ও সহায়তা দেয় এবং চলমান গণহত্যা ও গাজার অবরোধ শেষ করতে দখলদার শক্তির ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করে। এছাড়াও হামাস বিশ্বজুড়ে স্বাধীনচেতা মানুষদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, তারা যেন ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতি আরও জোরদার করে এবং দখলদারদের গণহত্যা ও সম্মিলিত শাস্তি নীতির বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করে।

এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য চলমান আলোচনার অংশ হিসেবে ইসরাইল তাদের সেনা প্রত্যাহারে একটি প্রাথমিক চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, এই প্রস্তাব হামাসের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। হামাসের সম্মতি পাওয়া গেলে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে, পাশাপাশি বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়াও শুরু হবে। তিনি আরও বলেন, এই পরিকল্পনা ‘পরবর্তী ধাপের প্রত্যাহারের শর্ত তৈরি করবে’ এবং সংঘাতকে ‘এই ৩ বছরের বিপর্যয়ের অবসানের দিকে নিয়ে যাবে।

নেতানিয়াহুকে নিয়ে তুরস্কের সতর্কবার্তা : তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান সতর্ক করে বলেছেন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যে কোনো মুহূর্তে গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটানোর চলমান প্রচেষ্টা ভেস্তে দিতে পারেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইসরাইলি মন্ত্রিসভার আচরণ যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগগুলোকে বিপন্ন করে তুলছে।

এদিকে হিব্রু দৈনিক ইয়েদিয়থ আহরোনথ বলছে, নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনাকে বিপদের মুখে ফেলেছে। এছাড়া সিরিয়া প্রসঙ্গে পৃথক মন্তব্যে ফিদান বলেন, তুরস্ক কোনো ধরনের বিদেশি হস্তক্ষেপ বা দেশটিকে বিভক্ত করার প্রচেষ্টা মেনে নেবে না। তিনি আরও জানান, আঙ্কারার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বর্তমানে সিরিয়ার সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার ওপর কেন্দ্রীভূত। এছাড়া তিনি আসন্ন সংসদীয় নির্বাচনকে ‘সিরিয়ার জন্য এক ঐতিহাসিক মাইলফলক’ হিসেবে আখ্যা দেন। ফিদানের এই সতর্কবার্তা ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর গাজায় সামরিক আগ্রাসন অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করার কয়েক ঘণ্টা পর দেওয়া হয়।

‘ইসরাইল যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার জন্য দায়ী’ মনে করেন বেশিরভাগ ইহুদি: রোববার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জেরুজালেম পোস্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ ইহুদি গাজা যুদ্ধ চলাকালে ইসরাইলের আচরণে অসন্তুষ্ট বলে দাবি করেছে দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। এক জরিপে দেখা গেছে, ৬১ শতাংশ ইহুদিবাদী মনে করেন ইসরাইল যুদ্ধাপরাধ করেছে এবং চার জনের একজন দাবি করেছেন, দেশটি গণহত্যার জন্য দায়ী। জরিপ অনুযায়ী, ইসরাইলের বর্তমান সরকারের প্রতি অসন্তোষ বিশেষভাবে প্রবল। মোট ৬৮% ইসরাইলি দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে ৪৮% তার নেতৃত্বকে ‘দুর্বল’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন, যা পাঁচ বছর আগে পিউ রিসার্চ সেন্টার-এর জরিপের তুলনায় ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, যদিও ইহুদিরা হামাসকে যুদ্ধের জন্য দায়ী মনে করেন, তবুও অনেকেই প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর যুদ্ধনীতির প্রতি সমর্থন কমিয়েছেন।

গাজায় পৌঁছাতে কত সময় লাগবে- জানালেন শহিদুল আলম : ফিলিস্তিনের গাজায় রোববার পৌঁছানোর কথা থাকলেও আরও দেরি হবে বলে আগেই জানিয়েছেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। তাই লোকজন প্রশ্ন করছেন- তিনি এ মুহূর্তে ঠিক কোথায় আছেন, গাজায় পৌঁছাতে আর কত সময়ই বা লাগবে। এসবের জবাব দিয়েছেন শহিদুল আলম । গতকাল বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ১২টার পর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলম প্রশ্নের জবাব দেন। শহিদুল আলম লেখেন, ‘প্রথম প্রশ্নের ক্ষেত্রে, সবচেয়ে ভালো উপায়, ট্র্যাকার ব্যবহার করে আমাদের যাত্রাপথ অনুসরণ করা। ‘ফরেনসিক আর্কিটেকচার’, যার সঙ্গে আমরা আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ওপর একটি তদন্তমূলক ফিল্ম তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলাম—এই সাইটের মাধ্যমে কনশানস ও থাউজেন্ড ম্যাডলিনস উভয় নৌবহরের যাত্রাপথ ট্র্যাক করছে।’ দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে শহিদুল আলম লেখেন, ‘এর উত্তর নির্ভর করছে আইডিএফ (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) আমাদের ওপর কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটার ওপর। অতীতের ঘটনাগুলো দেখলে বোঝা যায় যে তারা আমাদের যেতে দেবে না। আটক করা হতে পারে। এরপর আমাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে, নয়তো কারাগারে পাঠানো হতে পারে। কখন, কোথায় এটা ঘটতে পারে, তা আগে থেকে বোঝা অসম্ভব। এটা আমাদের হাতে নেই।’ এ ক্ষেত্রে ‘আপনাদের সহায়তা প্রয়োজন’ উল্লেখ করে শহিদুল আলম পোস্টে আরও লেখেন, ‘যদি আপনারা এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন, যা আমাদের গাজায় পৌঁছানোর জন্য চাপ তৈরি করে, তবে সেটা হবে সর্বোত্তম ফলাফল। একমাত্র উপায় হলো ইসরায়েলের ওপর সাধারণ মানুষের পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ। কাজেই এবার আপনাদের সুযোগ, পদক্ষেপ নিন। এক হোন, প্রতিরোধ করুন। এটা অধিকার আর ন্যায়বিচারের জন্য একটি প্রচার। আমাদের একসঙ্গে এটা করতে হবে।’

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে গতকাল সকালে শুভেচ্ছাবার্তা পাওয়ার কথাও ফেসবুক পোস্টে জুড়ে দিয়েছেন শহিদুল আলম। শহিদুল আলম গাজা অভিমুখে থাকা কনশানস নৌযানে আছেন। কনশানস হলো আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি)’ ও ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা (টিএমটিজি)’ নৌবহরের একটি জাহাজ। এফএফসি হলো ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙতে ও গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে বৈশ্বিক প্রচেষ্টা ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার’ যৌথ আয়োজক জোটগুলোর একটি। তবে তাদের বহরে কোনো খাদ্যসহায়তা নেই।

আটক গ্রেটা থুনবার্গকে নির্যাতন ও ইসরায়েলি পতাকায় চুমু খেতে বাধ্য করার অভিযোগ: ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ থেকে আটক হওয়া সুইডিশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও তাকে নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে। ইসরায়েলের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ফেরার পর এ অভিযোগ করেন ওই নৌবহরে অংশ নেওয়া কয়েকজন আন্তর্জাতিক অধিকারকর্মী।

এদিকে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটক হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৩৭ জনকে গতকাল শনিবার তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৩৬ জন তুরস্কের নাগরিক। অন্যরা যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, মালয়েশিয়া, কুয়েত, সুইজারল্যান্ড, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, জর্ডানসহ বিভিন্ন দেশের অধিকারকর্মী বলে জানান তুরস্কের কর্মকর্তারা। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে গত শনিবার ইস্তাম্বুলে ফেরেন তুরস্কের সাংবাদিক এরসিন সেলিকও। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় অংশ নেওয়া সেলিক স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তিনি দেখেছেন, ইসরায়েলি বাহিনী গ্রেটা থুনবার্গকে নির্যাতন করেছে, মাটির ওপর দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে এবং ইসরায়েলি পতাকায় চুমু খেতে বাধ্য করেছে।

ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে একই কথা বলেন মালয়েশিয়ার অধিকারকর্মী হাজওয়ানি হেলমি ও যুক্তরাষ্ট্রের উইন্ডফিল্ড বিবার। তাঁদের ভাষ্যমতে, থুনবার্গকে ধাক্কা দিয়ে তাঁর গায়ে জোর করে ইসরায়েলি পতাকা মুড়িয়ে দেওয়া হয়।

হাজওয়ানি হেলমি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা ছিল দুর্বিষহ। ওরা আমাদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করেছে।’ আটক করার পর অধিকারকর্মীদের খাবার, সুপেয় পানি ও ওষুধ দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

উইন্ডফিল্ড বিবার অভিযোগ করেন, থুনবার্গের সঙ্গে ভয়ানক আচরণ করা হয়েছে। তাকে প্রচারের মাধ্যম বানানো হয়েছে। অভিজ্ঞতা হাতড়ে এই মার্কিন বলেন, একটা কক্ষে ইসরায়েলের উগ্র দক্ষিণপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির প্রবেশ করার পর সেখানে ধাক্কা মেরে গ্রেটাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

ইতালির সাংবাদিক লরেঞ্জো আগোস্তিনোও গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটক হয়েছিলেন। তিনিও থুনবার্গের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার কথা জানান। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম আনাদোলুকে তিনি বলেন, ‘গ্রেটা থুনবার্গ একজন সাহসী নারী। বয়স মাত্র ২২ বছর। তাকে অপমান করা হয়েছে। তার গায়ে ইসরায়েলি পতাকা মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে একটি ট্রফির মতো প্রদর্শন করা হয়েছে।’

দুর্ব্যবহারের কথা জানান আটক হওয়ার পর ফিরে আসা আরও কয়েকজন অধিকারকর্মী। তুরস্কের টেলিভিশন উপস্থাপক ইকবাল গুরপিনার বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কুকুরের মতো আচরণ করা হয়েছে। তিন দিন ধরে আমাদের খাবার দেওয়া হয়নি, পানি দেওয়া হয়নি। টয়লেটে থাকা পানি খেতে হয়েছে। ভীষণ গরম ছিল। আমরা রীতিমতো ঝলসে গেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘গাজাবাসীর সঙ্গে আসলে কী ঘটছে, এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি।’ তুরস্কের অধিকারকর্মী আয়চিন কানতুগলু ইসরায়েলি বন্দিশালায় রক্তমাখা দেয়ালে আগের বন্দীদের নানা লেখা দেখতে পাওয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, মায়েরা নিজেদের সন্তানের নাম দেয়ালে লিখে গেছেন। আমরা আসলেই কিছুটা অনুভব করতে পেরেছি, ফিলিস্তিনিরা কোন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন।’

ইতিমধ্যে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি জানান, তার দেশের ২৬ জন নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে ১৫ জন এখনো ইসরায়েলে আটক রয়েছেন। আটক হওয়া অধিকারকর্মীদের বরাতে ইসরায়েলি অধিকার সংস্থা আদালাহ জানিয়েছে, বন্দীদের হাত বেঁধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁদের খাবার, পানি, ওষুধ দেওয়া হয়নি। টয়লেটে যেতে দেওয়া হয়নি। আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতেও বাধা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের আইনি অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। তবে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব অভিযোগকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।

গাজা যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইউরোপজুড়ে বিক্ষোভ, লন্ডনে ৫০০ গ্রেপ্তার: গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে ও যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইউরোপজুড়ে বড় বড় শহরে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ–মিছিল করেছেন। যুক্তরাজ্য, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালসহ বিভিন্ন দেশে এসব বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। স্পেনের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর বার্সেলোনা ও রাজধানী মাদ্রিদে গত শনিবার যে বিক্ষোভ হয়েছে তার ডাক দেওয়া হয়েছিল কয়েক সপ্তাহ আগেই। তবে ইতালির রোম ও পর্তুগালের লিসবনে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয় গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’কে ইসরায়েল আটক করার পর। ইসরায়েলি বাহিনী ভূমধ্যসাগরে থাকতেই নৌবহরটি আটক করেছে। ইসরায়েলের নৃশংস হামলা ও দুর্ভিক্ষে বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙার চেষ্টা হিসেবে এ নৌবহর বার্সেলোনা থেকে রওনা দিয়েছিল।

নৌবহর থেকে আটক ৪৫০ মানবাধিকারকর্মী ও অন্যদের মধ্যে ৪০ জনের বেশি স্পেনের নাগরিক। তাদের মধ্যে বার্সেলোনার একজন সাবেক মেয়রও রয়েছেন। এদিকে গাজার জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে গত শুক্রবার ইতালিতে এক দিনের সাধারণ ধর্মঘটে ২০ লাখের বেশি মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন।

গত কয়েক সপ্তাহে স্পেনে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশটির সরকার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চরম দক্ষিণপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করছে। গত মাসে একটি সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ইসরায়েলি একটি দল স্পেনে গিয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা সেখানে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। এতে প্রতিযোগিতার আয়োজন ব্যাহত হয়। ওই সময় স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ গাজায় চলমান যুদ্ধকে ‘জাতিহত্যা’ বলে আখ্যা দেন এবং আন্তর্জাতিক সব ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ইসরায়েলি দলের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। ইউরোপজুড়ে যখন এই বিক্ষোভ–সমাবেশ চলছিল সে সময়ে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বলেছে, তারা গাজা যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাব আংশিকভাবে মেনে নিতে রাজি আছে। গাজায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধে ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে উপত্যকাটি। বার্সেলোনার টাউন হল কর্তৃপক্ষ বলেছে, সেখানে শনিবারের বিক্ষোভে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে ধারণা পুলিশের। বিক্ষোভে অংশ নিতে অন্য একটি শহর থেকে এক ঘণ্টা যাত্রা করে বার্সেলোনা এসেছেন ৬৩ বছর বয়সী মারিয়া জেসুস পাররা। বিক্ষোভ–মিছিলে তিনি ফিলিস্তিনের পতাকা উঁচু করে ধরে ছিলেন। মারিয়া বলেন, তিনি চান, তিনি টেলিভিশনে প্রতিদিন গাজায় নৃশংসতার যে ভয়াবহ চিত্র দেখেন তার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।

মারিয়া বলেন, ‘১৯৪০–এর দশকে (ইউরোপে যেমন) দেখেছিলাম, তেমন একটি জাতিহত্যা এবার আমরা চোখের সামনে ঘটতে দেখছি, এও কীভাবে সম্ভব? এখন আর কেউ এটা বলতে পারবে না যে, সেখানে কী ঘটছে, তারা সেটা জানতেন না।’

লন্ডনে গ্রেপ্তার: ম্যানচেস্টারে একটি সিনাগগে প্রাণঘাতী হামলার পর পুলিশ লন্ডনে গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ স্থগিত করার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু অনুরোধ উপেক্ষা করে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন প্যালেস্টাইন অ্যাকশনের সমর্থনে লন্ডনে গতকাল একটি বিক্ষোভ–মিছিল বের হয়। পুলিশ মিছিল থেকে অন্তত ৪৪২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। দ্য গার্ডিয়ান তার প্রতিবেদনে এই সংখ্যা ৫০০ বলে জানিয়েছে। ইসরায়েলি বন্দিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে তেলআবিবে বিক্ষোভ: শিগগিরই যুদ্ধ বন্ধ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি চুক্তির ব্যাপারে নেতানিয়াহু সরকারকে সম্মতি জানাতে বিক্ষোভে উত্তাল ইসরায়েল। গত শনিবার রাজধানী তেলআবিবের হোস্টেজ স্কয়ারে জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ। তাদের হাতে ছিল ব্যানার-ফেস্টুন। সাপ্তাহিক এই র‍্যালিতে অংশ নেন সব শ্রেণী-পেশা ও বয়সের মানুষ। এ সময়, জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনার চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি আহবান জানান আন্দোলনকারীরা। একইসাথে, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু’র সদিচ্ছা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন অনেকে। তাদের অভিযোগ, প্রতিবারের মত এবারও হয়তো চুক্তি বানচালের চেষ্টা করবেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। তাই, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে ট্রাম্পের ওপরই ভরসা রাখছেন, জিম্মিদের পরিবার-স্বজনরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত