
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারির তরুণদের উদ্যোগে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেলেও ‘শাপলা’ প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার নিচ্ছে।
জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন ‘শাপলা’ প্রতীককে ঘিরে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতীক বিতর্কের এই পরিস্থিতি নির্বাচনি প্রস্তুতিকে নতুন করে চাপে ফেলতে পারে।
সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন কোনো দলকে শাপলা প্রতীক বরাদ্দ দেয়নি, নির্বাচনের প্রতীক তালিকাতেও রাখেনি। কিন্তু এনসিপি শাপলা প্রতীকের দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছে। ইসির কাছে শাপলা প্রতীক চেয়ে গতকাল মঙ্গলবার আবারও চিঠি দিয়েছে দলটি। ইসির কাছে সাতটি নমুনা এঁকে পাঠানো হয়েছে দলের পক্ষ থেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাপলা প্রতীক নিয়ে দুই পক্ষের অনড় অবস্থান দেখে অনেকে আশঙ্কা করছেন। এ প্রতীকের দাবিতে এনসিপি মামলা করতে পরে। সেক্ষেত্রে যে কোনো সময় ভোট আটকে যেতে পারে। তফসিলের আগে বিষয়টি সুরাহা না হলে জনমনে ভোট নিয়ে আশঙ্কা থেকে যাবে। আবার এনসিপি যদি শেষ পর্যন্ত শাপলা বাদে অন্য কোনো প্রতীক না নিতে চায়, সেটি নতুন করে সংকটও তৈরি করতে পারে।
এমনকি প্রতীক নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হলে এনসিপির নিবন্ধন পাওয়ার বিষয়টি আটকে থাকতে পারে।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেছেন, ‘কোনো দলের নামে তো শাপলা প্রতীক বরাদ্দ দেয়নি ইসি; সেক্ষেত্রে অন্যকে দেওয়ার বিষয়ে মামলা করা না করার কি রয়েছে? ইসি প্রতীকের বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করেছে। এখন এককভাবে আমার আর কিছু বলার নেই।’ তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত যেগুলো নিষ্পত্তি করা হয়েছে কমিশনের সিদ্ধান্তই তো হয়েছে। এ ব্যাপারে ভুলের কোনো কারণ নেই।’
এ বিষয়ে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ইসি যদি শাপলা প্রতীক না দেয় তাহলে এই কমিশনের কোনো কার্যক্রমে আমাদের আস্থা থাকবে না। এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম জানান, আইনগত ও নৈতিকভাবে তারা শাপলা প্রতীক রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, আমরা যেহেতু আইনগতভাবে শাপলা প্রতীকের অধিকারী, তাই আমরা অবশ্যই শাপলাই চাই। এমনকি তাদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে আমরা লাল শাপলা কিংবা সাদা শাপলার কথাও বলেছি। কিন্তু এর বাইরে এনসিপি অন্য কোনো প্রতীকের কথা চিন্তাও করছে না। এনসিপি আগামী নির্বাচনে শাপলা প্রতীক নিয়েই অংশ নেবে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু আইনগতভাবে শাপলা প্রতীক পেতে এনসিপির কোনো সমস্যা নেই। তাই এখানে নির্বাচন কমিশন স্পষ্টভাবে স্বেচ্ছাচারিতা করছে। নির্বাচন কমিশনের এই স্বেচ্ছাচারিতা নিশ্চয়ই কোনো প্রভাবকের প্রভাবে ঘটছে। হতে পারে কোনো রাজনৈতিক দল, সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দিচ্ছে না।
জানা যায়, নিবন্ধিত দল নাগরিক ঐক্য তাদের বরাদ্দ পাওয়া ‘কেটলি’ প্রতীকের পরিবর্তে শাপলা চেয়ে আবেদন করেছিল। তাদের আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন ইসি।
এরপর এনসিপি শাপলা প্রতীক চেয়ে চিঠি দেয়। কিন্তু শাপলা প্রতীক তালিকাতেই না রাখার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন পরিচালনা বিধির প্রতীক তালিকা সংশোধন করে আরও কিছু নতুন প্রতীক যুক্ত করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
সবশেষ ২৪ সেপ্টেম্বর প্রতীক তালিকার গেজেট প্রকাশ করে ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানিয়ে দেন, সংশোধিত তালিকায় শাপলা নেই; তাই এটা এনসিপির তা পাওয়ারও সুযোগ নেই। সেদিনই এনসিপি ফের শাপলা প্রতীক বরাদ্দ চেয়ে নিজেদের অনড় অবস্থান তুলে ধরে কমিশনকে চিঠি দেয়। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন ‘শাপলা’ প্রতীক নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘এনসিপি শাপলা চেয়েছে এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অথচ শপলা চেয়েছিল নাগরিক ঐক্য, তারা প্রথম চেয়েছিল। তখন আলোচনায় আনেনি। এখন কেন এত আলোচনা?’ সিইসির ভাষ্য, এটা কমিশনের সিদ্ধান্ত। কমিশন নানা বিষয় বিবেচনায় নিতে পারে। তিনি বলেন, ‘এখন প্রত্যেকটা ডিসিশনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে তাহলে মুশকিল আছে। এ পর্যন্ত যত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নাগরিক ঐক্যের বিষয়ে যে ডিসিশন নিয়েছি, ওটাও কমিশনের সভায় নিয়েছি।’ সম্প্রতি ইসি এনসিপিকে ১১৫টি প্রতীকের মধ্যে বাকি থাকা ৫০টি থেকে বাছাই করতে বলা হয়েছে এনসিপিকে। এ তালিকায় থাকা কলম ও মোবাইল ফোন আগে এনসিপির পছন্দের তালিকায় থাকলেও নিবন্ধন আবেদনের পরে সংশোধিত চিঠিতে দলটি শাপলা, সাদা শাপলা বা লাল শাপলা চায়। এনসিপিকে নির্ধারিত তালিকা থেকে প্রতীক বাছাইয়ের জন্য গতকাল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি পাঠায় ইসি।
ইসি জানায়, এনসিপির আবেদনপত্রে পছন্দের প্রতীকের ক্রম ছিল শাপলা, কলম অথবা মোবাইল। তবে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৯(১) অনুযায়ী ‘শাপলা’ বর্তমানে বরাদ্দের জন্য নির্ধারিত প্রতীকের তালিকায় নেই।
ইসির চিঠিতে বলা হয়েছে, দলটিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৯০চ (১) (খ)-এর নিয়ম সম্পর্কে অবগত করা হয়েছে। ওই নিয়ম অনুযায়ী এই আদেশ বা বিধিমালার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোনো দলের মনোনীত সব প্রার্থীর জন্য নির্ধারিত প্রতীকগুলোর মধ্য থেকে পছন্দ করা একটি প্রতীক বরাদ্দ করা হবে। বরাদ্দকৃত প্রতীকটি সেই দলের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, যদি না দলটি পরবর্তীতে তালিকার অন্য কোনো প্রতীক নিতে চায়। এবং ২০০৮-এর বিধি ৯(১)-এর অন্তর্ভুক্ত এমন একটি প্রতীক নির্বাচন করে কমিশনকে ৭ই অক্টোবরের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ নিবন্ধনের পরবর্তী প্রক্রিয়ার জন্য বরাদ্দ না হওয়া প্রতীকগুলোর মধ্যে থেকে দলটিকে প্রতীক বাছাই করতে হবে।
ইসি এনসিপিকে নির্বাচনী প্রতীক পছন্দের জন্য যে ৫০টি প্রতীকের তালিকা দিয়েছে, সেগুলো হলো- আলমিরা, উটপাখি, কলম, কলস, কাঁপ-পিরিচ, কম্পিউটার, কলা, খাট, ঘুড়ি, চার্জার লাইট, চিংড়ী, চশমা, জগ, জাহাজ, টিউবওয়েল, টিফিন ক্যারিয়ার, টেবিল, টেবিল ঘড়ি, টেলিফোন, তবলা, তরমুজ, থালা, দালান, দোলনা, প্রজাপতি, ফুটবল, ফুলের টব, ফ্রিজ, বক, বালতি, বাঁশি, বেগুন, বেঞ্চ, বেলুন, বৈদ্যুতিক পাখা, মগ, মাইক, মোরগ, ময়ূর, মোড়া, মোবাইল ফোন, লাউ, লিচু, শঙ্খ, সেলাই মেশিন, সোফা, স্যুটকেস, হরিণ, হাঁস এবং হেলিকপ্টার।
ফের ইসির কাছে শাপলা প্রতীক চেয়েছে এনসিপি : আবারও ইসি কাছে শাপলা প্রতীক চেয়ে চিঠি দিয়েছে এনসিপি। ইসির কাছে ৭টি নমুনা আঁকিয়ে পাঠিয়েছে দলটি। মঙ্গলবার এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠি ইসি সচিবের কাছে পাঠিয়েছে দলটি। এনসিপি তাদের জবাবে বলেছে, গণমানুষের সঙ্গে শাপলা প্রতীক কেন্দ্রিক গভীর সংযোগ স্থাপিত হয়েছে এবং এটি ব্যতীত ইসির দেওয়া তালিকা থেকে অন্য কোনো প্রতীক পছন্দ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ঘটনার ক্রম ও এনসিপির অভিযোগ এনসিপি তাদের চিঠিতে একাধিকবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে প্রতীক নিয়ে হওয়া আলোচনার ধারাবাহিকতা তুলে ধরেছে।
প্রতীক তালিকাভুক্তি উদ্যোগ : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসি নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, ২০০৮ এর বিধি ৯ (১) এ নতুন করে প্রতীক তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। এনসিপির দাবি সংশ্লিষ্ট কমিটি মোট ১৫০টি প্রতীক অন্তর্ভুক্তির চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত করেছিল এবং গত ৪ জুন ইসির একজন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে এনসিপিকে আশ্বস্ত করা হয় যে, চূড়ান্ত তালিকায় ‘শাপলা’ প্রতীক রয়েছে। এর আগে, গত ২২ জুন এনসিপি নিবন্ধনের জন্য আবেদন দাখিল করে এবং ‘শাপলা’ প্রতীক সংরক্ষণের আবেদন জানায়। পরবর্তীতে ৩ আগস্ট এনসিপি প্রতীক সংরক্ষণের ক্রম হিসাবে ১. শাপলা, ২. সাদা শাপলা এবং ৩. লাল শাপলা পছন্দ করে চিঠি পাঠায়। এনসিপি অভিযোগ করেছে, তাদের ৩ আগস্ট ও ২৪ সেপ্টেম্বরের দরখাস্তের বিষয়ে কমিশন অদ্যাবধি কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়েই (অর্থাৎ দরখাস্ত দুটি অনিষ্পন্ন অবস্থায় রেখে) ৩০ সেপ্টেম্বরের সূত্রোক্ত চিঠি প্রেরণ করেছে, যা বিধিসম্মত হয়নি।
চিঠিতে এনসিপি জানায়, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীসহ সারাদেশের ১০১ জন বিজ্ঞ আইনজীবী শাপলাকে প্রতীক হিসাবে বরাদ্দ দিতে কোনো আইনি বাধা নেই বলে ইতোপূর্বে বিবৃতি দিয়েছেন। এমনি কি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন যে, ‘শাপলা’ প্রতীক এনসিপিকে না দেওয়াটা খুব বেশি আইনি জটিলতা বলে আমি মনে করি না, এটা দেওয়া যেতেই পারে। এছাড়া নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাও এনসিপির অনুকূলে শাপলা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে তার দলের ইতিবাচক অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। এনসিপি মনে করে, শাপলাকে প্রতীক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করা এবং এনসিপিকে বরাদ্দ না দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত কোনো আইনি ভিত্তি দ্বারা গঠিত নয়, বরং এনসিপির প্রতি বিরূপ মনোভাব ও স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। তাদের মতে, ইসি প্রতীক ইস্যুতে অন্যায্য আচরণ করছে, যা স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইসির গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
নির্বাচনি কার্যক্রমে বঞ্চনার অভিযোগ : চিঠিতে এনসিপি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় বিলম্ব করা এবং শাপলা প্রতীক বরাদ্দ না দিয়ে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত, আইনবহির্ভূত, বৈষম্যমূলক এবং স্বেচ্ছাচারী আচরণ’ করার অভিযোগ এনেছে। এনসিপি মনে করে, এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন অসৎ উদ্দেশ্যে এনসিপিকে নির্বাচনি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বঞ্চিত করছে, যা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে ইসির সদিচ্ছাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। সার্বিক বিবেচনায় জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি আশা করে, নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালের নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার বিধি ৯(১) সংশোধনক্রমে এনসিপির অনুকূলে ১. শাপলা, ২. সাদা শাপলা এবং ৩. লাল শাপলা থেকে যেকোনো একটি প্রতীক বরাদ্দ করবে।