
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় গুরুত্বপূর্ণ এক বৈঠক। আলোচনার সূচনাকালে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি ‘চূড়ান্ত রোডম্যাপ’ প্রণয়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও প্রস্তাবগুলো আমরা অন্তর্ভুক্ত করছি। আশা করছি, শুক্রবারের মধ্যেই সরকারকে এই চূড়ান্ত রোডম্যাপ জমা দেওয়া সম্ভব হবে। জানা গেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে এই সনদ বাস্তবায়নের কথা বলছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েক দল নির্বাচনের আগেই এ সনদ বাস্তবায়ন চায়। মূলত এ বিরোধ নিয়ে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোটের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। ফলে এখনকার পরিস্থিতিটা হচ্ছে, গণভোটের পথে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে আর কী কী পদক্ষেপ নিতে পারি, যেটা নিশ্চিত করে যে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাব। গত দিনের আলোচনায় যে অগ্রগতি হয়েছে, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা এক জায়গায় আসতে পেরেছি একটি ধাপ হিসেবে। মনে করি, বাকি অংশগুলো আমরা নিষ্পত্তি করতে পারব। গোটা দেশ অপেক্ষা করছে, আমরা সকলে মিলে এমন একটি ঐকমত্যের জায়গায় পৌঁছতে পারব, যাতে করে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের পথরেখাটা নির্ধারিত হয়। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘মৌলিক ঐকমত্য’ তৈরি হয়েছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন এখন চূড়ান্ত কাঠামো নির্ধারণে কাজ করছে। কমিশন চায় সব দলের মতামত ও আপত্তির পর্যালোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত প্রস্তাব তৈরি করে সরকারকে সুপারিশ করতে। আলী রীয়াজ দলগুলোর উদ্দেশে বলেন, আপনাদের পক্ষ থেকে যদি সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট একটি জায়গায় একটি প্রস্তাব আসে, কমিশন সরকারকে সেটাই উপস্থাপন করবে এবং কমিশন চাইবে যে সেটাই বাস্তবায়িত হোক।
নভেম্বরে গণভোট চায় জামায়াত : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের বিরতিতে বুধবার রাতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, গণভোটও সুষ্ঠু হবে না। তাই গণভোট আগে হওয়াই যুক্তিযুক্ত। ডা. তাহের বলেন, গণভোটের বিষয়ে সবাই একমত। নভেম্বরের মধ্যেই গণভোটটা আলাদাভাবে হয়ে যাওয়া দরকার। কিছু বিষয়ে আমাদের মতভিন্নতা থাকলেও গণভোট নিয়ে এখন আর কোনো বিরোধ নেই। জুলাই চার্টারের যে সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে, সেটি গণভোটের মাধ্যমেই গৃহীত বা বাতিল হবে। তিনি বলেন, অনেকেই বলেছেন, গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন একসাথে হয় বা একসাথে হলে ভালো হয়। আমরা বলেছি না, গণভোট একটি আলাদা বিষয়, জাতীয় নির্বাচন একটি আলাদা বিষয় এবং দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গণভোটটি হবে আমাদের সমস্ত সংস্কার— জুলাই সনদ হিসেবে যেটাকে আমরা একটি প্যাকেজ হিসেবে বিবেচনা করছি। সেটাকে নিয়ে গণভোট হবে। সুতরাং গণভোটটা আগেই হয়ে যাওয়া দরকার। জনগণ যদি গ্রহণ করে, সেই গণভোটের ভিত্তিতেই পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো হবে, নির্বাচন হবে। আর জনগণ যদি বাতিল করে দেয়, তাহলে তো সেটা এখানে শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং বিষয়টা খুব স্পষ্ট হবে। নির্বাচনের আগেই গণভোট হবে এবং নির্বাচন তার ভিত্তিতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের অবস্থান হচ্ছে গণভোট হবে-এ ব্যাপারে আমরা সবাই একমত। কিন্তু গণভোটটি নভেম্বরের শেষের দিকে যদি হওয়া যায়, কারণ আমাদের কাছে রেকর্ড আছে, বাংলাদেশেই ১৯ দিনের ব্যবধানেও গণভোট হয়েছে। এক মাসের ব্যবধানেও গণভোট হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে এবং নভেম্বরের ভিতরেই জুলাই চার্টারের ওপরে আমাদের গণভোট হবে।
সীমান্তের ওপারের শক্তির কারণেই জুলাই সনদ নিয়ে একমত হওয়া যাচ্ছে না- মঞ্জু : গতকাল সন্ধ্যায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের বিরতিতে সাংবাদিকদের সামনে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, ‘সীমান্তের ওপারের শক্তির কারণেই জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে ঐকমত্য হচ্ছে না। তাই বিষয়টি নিয়ে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ এ বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। সংবিধান আদেশ বা অধ্যাদেশ যেভাবেই হোক বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। কারণ জনগণ দ্রুত সিদ্ধান্ত দেখতে চায়।’
মঞ্জু অভিযোগ করেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে গণভোট সংসদ নির্বাচনের আগে হবে না। ভোটের দিন যে হবে সে বিষয়টিতেও এখনও একমত হতে পারেনি দলগুলো। এ সংক্রান্ত দুই পক্ষের মধ্যে স্পষ্ট দ্বিমত দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নিজেদের সরকারের অংশ মনে করে। আমরা মনে করি তাদের কারণে একমত হওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জনগণ ঐকমত্য চায়। সংবিধান আদেশ বা বিশেষ আদেশ যেভাবেই হোক।’ তিনি বলেন, ‘কোনও বিষয়ে কারও দ্বিমত থাকলে, জনগণ থার্ড আম্পায়ার হিসেবে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা মনে করি, গণভোট সাধারণ নির্বাচনের আগে বা পরে নেওয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের আপত্তি নেই।’
কমিশনকেই উদ্যোগ নিতে হবে- রাশেদ খান : গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেছেন, জুলাই সনদের বিষয়ে আজকের (গতকাল) মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। কারণ গত ৯ মাস এ নিয়ে এক ধরনের তামাশা চলছে। বিভিন্ন দল নিজেদের মতামত দেবে। এভাবে চলতে থাকলে কখনও ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে কমিশনকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
রাশেদ বলেন, গত বৈঠকে বলা হয়েছিল আজকের (গতকাল) মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। অথচ আজ (বুধবার) মনে হলো কমিশনের বৈঠক নতুন করে শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম কিছু উপদেষ্টা নাকি হাসিনার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। আর এখন মনে হয়, আমরাও দলগুলোও হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। দেখা গেলো অনেক দল গত বৈঠকের একমত হওয়া বিষয়গুলোতে মত পাল্টিয়ে ফেলেছে। এ বিষয়ে আমরা হতাশ। তিনি বলেন, যেখানে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, সেখানে আমরা নির্বাচনের কাজ না করে দিনের পর দিন এখানে আসছি। কিন্তু কোনও সমাধান হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে কমিশনও ভিন্নমত প্রকাশ করছে। ভোটের দিনে গণভোট নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত অব্যাহত রাখছে দলগুলো। যেহেতু আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস কম, তাই সনদের পক্ষে গণভোটের কথা বলেছি। আর সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে এর প্রয়োজন হতো না।
রাশেদ বলেন, নোট অব ডিসেন্ট সেগুলোর ক্ষেত্রে গণভোটের কথা বলেছি। এ নিয়ে অনৈক্য হলে কামড়াকামড়ি করে আমরা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবো। তাই নোট অব ডিসেন্ট কমানো যায় কিনা, সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণভোটে যেতে হবে। সুপারিশ করে পার পাবে না কমিশন। তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভিন্নমতকে একমতে আনতে হবে। সকাল-বিকাল সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে জাতি বিভক্ত হবে। কারণ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে দেশ মহাসংকটে পরবে।