
বন্দিবিনিময় চুক্তি অনুমোদনের পর আজ শনিবার ভোর থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা দক্ষিণ গাজা থেকে দলে দলে উত্তর গাজায় ফিরছেন। গাজাজুড়ে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০ জন ইসরায়েলি বন্দি এখনও জীবিত আছেন। এর বিনিময়ে শতাধিক ফিলিস্তিনি বন্দিকে ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। চুক্তির আগে এক সংসদীয় বৈঠকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানান, যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মধ্যস্থতা ও চুক্তি সম্পন্ন করতে সহায়তার জন্য। অন্যদিকে হামাসের নির্বাসিত গাজা প্রধান খলিল আল-হাইয়া জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেয়েছেন যে, এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে। এদিকে, গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির বাস্তবায়ন তদারকিতে ইসরায়েলে ২০০ সেনা পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনটাই নিশ্চিত করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর। এই সেনারা মার্কিন সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ড-এর অধীনে কাজ করবেন। মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন গঠিত টাস্কফোর্সটির নাম হবে সিভিল-মিলিটারি কো-অর্ডিনেশন সেন্টার, যা গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির অগ্রগতি এবং মানবিক সহায়তার প্রবাহ তদারকি করবে। অফিসিয়াল সূত্র বলছে, সেনারা ইসরায়েলে অবস্থান করলেও তারা গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করবেন না। তাদের কাজ হবে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মানবিক সহায়তা, নিরাপত্তা সমন্বয় ও অবকাঠামো পুনর্গঠনে সহায়তা করা। টাস্কফোর্সে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও মিশর, কাতার ও তুরস্কের সেনা প্রতিনিধি থাকবেন। ধারণা করা হচ্ছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতও এই উদ্যোগে যোগ দেবে।
আমরা যুদ্ধের সম্পূর্ণ সমাপ্তির নিশ্চয়তা পেয়েছি- হামাস : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধের সম্পূর্ণ সমাপ্তির নিশ্চয়তা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের বর্তমান শীর্ষ নেতা খলিল আল-হায়া। বৃহস্পতিবার রাতে এক ভিডিওবার্তায় এ তথ্য জানিয়েছেন তিনি।
ভিডিওবার্তায় খলিল আল হায়াকে বলতে দেখা গেছে, ‘গাজায় যুদ্ধ সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। আমরা আমাদের ভাতৃপ্রতিম মধ্যস্থতাকারী এবং মার্কিন প্রশাসনের কাছ থেকে এই নিশ্চয়তা পেয়েছি।’ ভিডিওবার্তায় হামাসের বর্তমান এই শীর্ষ নেতা আরও জানান, এখন থেকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইসলামিক সংস্থা, দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করবে হামাস।
ইসরায়েলি মন্ত্রিসভায় গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন : ইসরায়েলি সরকার গতকাল ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন করেছে। মধ্যস্থতাকারীরা চুক্তির সমঝোতার ঘোষণা দেওয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা চুক্তি অনুমোদন করে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি বন্দীদের ছেড়ে দেবে। ইসরায়েল ধাপে ধাপে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করবে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ইংরেজি ভাষার এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টের পোস্টে বলা হয়েছে, ‘সরকার এইমাত্র জীবিত ও মৃত সব জিম্মিকে মুক্তির বিষয়ে চুক্তির কাঠামো অনুমোদন করেছে।’ যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণার পর ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। দুই বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের অবসানে একে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
গাজার কিছু অংশ থেকে সরতে শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী : যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় ইসরায়েলি সেনারা গাজার কিছু অংশ থেকে সরতে শুরু করেছেন। স্থানীয় কিছু বাসিন্দাও ইতিমধ্যে বিধ্বস্ত এলাকায় ফিরে এসেছেন। তবে আদৌ সংঘাতের অবসান হচ্ছে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন তারা। গাজা সিটির শেখ রাদওয়ান এলাকার বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী ইসমাইল জায়দা বলেন, ‘আমার বাড়িটি যে এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তা নিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি। তবে জায়গাটা ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার প্রতিবেশীদের ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, পুরো এলাকা গুঁড়িয়ে গেছে।’
যুদ্ধবিরতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে রাদওয়ান বলেন, ‘তারা যেভাবে বলছে, আদৌ কি তা শেষ হয়েছে? কেন কেউ এসে আমাদের বলছে না যে সত্যিই যুদ্ধবিরতি হয়েছে এবং আমরা নির্ভয়ে থাকতে পারি কি না।’ গাজা উপত্যকার দক্ষিণে খান ইউনিস শহরের বাসিন্দারা বলেছেন, ইতিমধ্যে পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা থেকে কিছু ইসরায়েলি সেনা সরে গেছেন। তবে ট্যাংকের গোলার শব্দ শোনা গেছে। গাজার কেন্দ্রস্থল নুসেইরাত শিবিরে দেখা গেছে, সেনারা তাদের অবস্থান থেকে সরে পূর্বে ইসরায়েলি সীমান্তের দিকে চলে গেছেন। তবে শুক্রবার ভোরে গুলির শব্দ শোনার পর অন্য কিছু সেনা ওই এলাকায় অবস্থান নেন। ইসরায়েলি বাহিনী গাজা নগরীর ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী সড়ক থেকেও সরে গেছে। শত শত মানুষ শহরের কেন্দ্রে ফেরার আশায় সেখানে জমায়েত হয়েছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, কাছাকাছি জায়গায় গুলির শব্দ শোনার কারণে অনেকেই এগোতে সাহস পাননি। শুধু অল্প কয়েকজন হেঁটে জায়গাটি পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। উদ্ধারকর্মীরা আগে গাজা শহরের যেসব এলাকায় যেতে পারেননি, এখন সেখানে পৌঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করেছেন। চিকিৎসকেরা বলছেন, এর আগে হামলা হয়েছে এমন এলাকা থেকে কমপক্ষে ১০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
যে কারণে ইসরায়েলে ২০০ সেনা পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র : যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি-সংক্রান্ত চুক্তিতে অনুমোদনের পর ইসরায়েলে ২০০ সেনা পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার কর্মকর্তারা জানান, অ্যাডমিরাল ব্র্যাড কুপারের নেতৃত্বে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড ইসরায়েলে ‘নাগরিক-সামরিক সমন্বয়কেন্দ্র’ স্থাপন করবে। এই ক্রেন্দ্র থেকে নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তার বিষয়টি সমন্বয় করা হবে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, অ্যাডমিরাল কুপারের অধীনে থাকা এই মার্কিন সেনারা অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সেনাসদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হবেন। মিসর, কাতার, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সেনারাও যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করবেন। একজন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা গাজায় প্রবেশ করবে না। ২০০ জনের প্রথম দল এরইমধ্যে ইসরায়েলে পৌঁছেছে। সপ্তাহ শেষের আগেই আরও সেনা মধ্যে এসে নতুন সমন্বয়কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করবে। এই সেনাদের মধ্যে মূলত সামরিক পরিকল্পনাকারী এবং লজিস্টিক, নিরাপত্তা ও অন্যান্য সহায়ক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা থাকছেন। এসব কেন্দ্রে সেনা, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং ত্রাণকর্মীরা একসঙ্গে কাজ করবেন। তাদের কাজ হবে— মানবিক সহায়তা দেওয়া, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তি ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা দেখা।
হামাস কি অস্ত্র সমর্পণ করবে? : যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপে ইসরায়েল ও হামাস সমঝোতায় পৌঁছালেও, এখনো বহু জটিল ইস্যু অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে- সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, হামাস কি তার অস্ত্রসমূহ সমর্পণ করবে?
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য হামাসকে সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্র হতে হবে, পাশাপাশি গাজা শাসন থেকে সরে গিয়ে সংগঠন হিসেবে নিজেদের বিলুপ্ত করতে হবে। অন্যদিকে, হামাস প্রকাশ্যে অস্ত্র সমর্পণের দাবি প্রত্যাখ্যান করলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, তারা অংশিকভাবে অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে গোপনে কিছু নমনীয়তা দেখিয়েছে।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিশেষজ্ঞ হিউ লাভাট বলেন, নিরস্ত্রীকরণের প্রশ্নে হামাসের অবস্থানেই সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দেখা গেছে। গোপনে তারা ইঙ্গিত দিয়েছে যে, আক্রমণাত্মক অস্ত্রগুলোর একটি অংশ তারা নিষ্ক্রিয় করতে রাজি হতে পারে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই ইস্যুটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে বিপন্ন করে তুলতে পারে- যদি হামাস সম্পূর্ণভাবে অস্ত্র ছাড়তে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে ইসরায়েল আবারও হামলা শুরু করতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গাজাভিত্তিক গবেষক আজমি কেশাওয়ি বলেন, হামাস হয়তো স্বল্প ও দীর্ঘ পাল্লার রকেটের মতো আক্রমণাত্মক অস্ত্র সমর্পণ করতে পারে। কিন্তু ছোট অস্ত্র বা গোপন টানেল নেটওয়ার্কের মানচিত্র কখনোই দেবে না। তার মতে, হামাস কেবল তখনই অস্ত্র ছাড়বে, যখন একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ইসরায়েল তার দখল শেষ করবে। গাজার অনেক ফিলিস্তিনি মনে করেন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় হামাসের কিছু সামরিক সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, কারণ ইসরায়েল গাজায় কিছু গ্যাং সংগঠনকে সহায়তা দিয়েছে- যারা এখন মানবিক সহায়তা লুট করছে। ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন বিশ্লেষক তাগরিদ খোদারি বলেন, ইসরায়েল নিজেই এমন গ্যাং তৈরি করেছে যারা এখন নিজেদের জনগণকে হত্যা করছে। হামাস না থাকলে গাজায় নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে। লাভাটের মতে, হামাস একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা টাস্কফোর্সের সঙ্গে আংশিক সহযোগিতায় রাজি হতে পারে, যদি সেই বাহিনী সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা না করে। আইসজি-এর কেশাওয়ি বলেন, ইসরায়েল হামাসকে যতই দমন করুক না কেন, গোষ্ঠীটি পুরোপুরি নির্মূল হবে না। হামাস এখন কেবল একটি সংগঠন নয়, এটি একটি প্রতিরোধের প্রতীক। তারা এমন এক যুদ্ধ লড়েছে যা কেউ কল্পনাও করেনি বলে জানান আইসজি-এর কেশাওয়ি।
শান্তিচুক্তির কিছু ধারা নিয়ে ‘কৌশল’ করছে ইসরাইল- হামাস : ফিলিস্তিন প্রতিরক্ষা আন্দোলন হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসিম বলেছেন, ইসরাইলের প্রশাসন শান্তিচুক্তির কিছু ধারাকে নিয়ে প্রতারণা এবং কৌশল প্রয়োগের চেষ্টা করছে। শান্তিচুক্তির ঘোষণা হওয়ার পর কাসিম গতকাল শুক্রবার জানান, ইসরাইল বন্দি তালিকা এবং গাজা থেকে প্রত্যাহার সম্পর্কিত ধারাগুলো কাজে লাগাতে চাচ্ছে, কিন্তু এ বিষয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলছে। এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে ইরানভিত্তিক মেহর নিউজ। তিনি উল্লেখ করেছেন, মূল বিষয় হলো বন্দিদের বিনিময়ের জন্য মাঠে উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করা। কাসিম বলেন, ‘শান্তিচুক্তি মানে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর যুদ্ধে অবসান।’ এদিকে, হামাস সকালে এক সরকারি বিবৃতিতে জানিয়েছে, মিশরীয় শহর শার্ম এল-শেখে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিচুক্তিতে পৌঁছানো হয়েছে। হামাস এবং ইসরাইলের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার সূত্রপাত হয় সোমবার, মিশর, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায়। আলোচনার লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ ধারার শান্তিচুক্তি প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করা। শান্তিচুক্তির ঘোষণার পর স্থানীয় সময় দুপুরে আরব ও ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে যে শান্তিচুক্তির প্রথম ধাপ কার্যকর হতে শুরু করেছে। একইসঙ্গে ইসরাইলি মন্ত্রিসভা এটি অনুমোদনও হয়েছে।