
দীর্ঘ ৩৬ বছর পর উৎসবমুখর পরিবেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। পাঁচটি ভবনের ১৫টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়, এর মধ্যে ১৪টি কেন্দ্রে হল সংসদ ও ১টি কেন্দ্রে হোস্টেল সংসদ নির্বাচন হয়। প্রতিটি ভবনে ১২টি করে মোট ৬০টি ভোটকক্ষ ছিল। বুধবার সকাল ৯টায় থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোট দেন শিক্ষার্থীরা।
এবার চাকসু নির্বাচনে আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ মিলিয়ে ১৩টি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এর মধ্যে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নিজেদের নামে প্যানেল দিলেও ইসলামী ছাত্রশিবির ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ নামে প্যানেলে নির্বাচন করে। এছাড়া ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ‘দ্রোহ পর্ষদ’ নামে প্যানেল দিয়ে চাকসুতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। এছাড়া কয়েকটি বাম ছাত্র সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলিয়ে ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ প্যানেলে নির্বাচনে অংশ নেয়। ভিপি পদে ২৪ এবং জিএস পদে ২২ জন ভোট করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে ছাত্রদল-যুবদলের অবস্থান : চাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে ছাত্রদল ও যুবদলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা জড়ো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর রেলগেট এলাকায় রফিক ছাত্রাবাসের সামনে ২০-৩০টি মোটরসাইকেলসহ শতাধিক বহিরাগত অবস্থান করে। তাদের নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সদস্যসচিব শরিফুল ইসলাম তুহিন। কিছুক্ষণ পরপর বাইক ও গাড়িতে করে জড়ো হয় স্থানীয় ছাত্রদল ও যুবদলের কর্মীরা। ক্যাম্পাসের আশেপাশে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অবস্থা নেওয়ায় আতঙ্কে পড়েন শিক্ষার্থীরা। সমাজতত্ত্ব বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী প্রতীক সিকদার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। এখানে শিক্ষার্থী বহিরাগতদের অবস্থান শোডাউন দেখলে শঙ্কার সৃষ্টি হয়। আমরা চাই না বাইরের কেউ আমাদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করুক। কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’ এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দীন বলেন, ‘আমি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করছি। বাইরে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের জড়ো হওয়ার বিষয়টি এসপিকে জানাচ্ছি। এই বিষয়টিতে তিনি অ্যাকশন নেবেন।’
ভোটার লাইনে ছাত্রদলের স্লিপ বিতরণের অভিযোগ শিবিরের প্রার্থীদের : চাকসু নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে ছাত্রদলের একাধিক ডেস্ক বসানো ও ভোটার লাইনে স্লিপ বিতরণের অভিযোগ করেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন রনি। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন তিনি। ইব্রাহিম হোসেন রনি বলেন, ‘এই নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সারাদেশের মানুষ এই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাই চাকসু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কমিশনের কাছে দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানিয়েছি। কেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে ছাত্রদল দুটি কেন্দ্রে দুটি ডেস্ক বসিয়েছে। এছাড়া সংগঠনটির কয়েকজন প্রার্থী ভোটারদের স্লিপ দিয়েছে।’ এ সময় তিনি প্রার্থীদের দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানান। সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোটের জিএস পদ প্রর্থী সাঈদ বিন হাবিব একই অভিযোগ তুলে বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে লিফলেট, স্লিপ দেওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আমরা দেখেছি, ছাত্রদলের লোকজন ভোটার লাইনে গিয়ে তাদের স্লিপ দিচ্ছেন। এটা আচরণবিধির লঙ্ঘন এবং ভোটারদের জন্য বিরক্তির কারণও বটে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’ এ বিষয়ে শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, শিবির প্লাস্টিক বিতরণ করছে। আমরা সেটা করছি না। ছাত্রশিবির আচরণবিধি লঙ্ঘন করতে পারলে আমরা করলে সমস্যা কী? তাছাড়া কোথায় দলের কর্মীরা স্লিপ বিতরণ করছে সেটার প্রমাণ হুয়াটস অ্যাপে পাঠাতে বলেন তিনি।
ভোটগ্রহণে ধীরগতি নিয়ে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের উদ্বেগ : চাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণে ধীরগতি এবং অমোচনীয় কালি ব্যবহার না করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোটে’র ভিপি (সভাপতি) প্রার্থী ইব্রাহীম রনি। তিনি বলেন, আমরা দেখছি, ভোট ধীরে চলেছে। তার প্যানেল ভোট জালিয়াতি রোধে অমোচনীয় কালি ব্যবহারের দাবি জানিয়েছিল। তিনি অভিযোগ করেন, ভোটে ব্যবহৃত কালি সহজেই মুছে ফেলা যাচ্ছে। আমি কেবল ভোট দিয়ে বের হলাম। আমার হাত দেখুন, কালি মুছে যাচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী কালি ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তা ১৫ মিনিটও টেকেনি,’ বলেন তিনি। ‘যদি কালি মুছে যায়, তবে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ২৮ হাজার শিক্ষার্থী এই প্রশ্ন তুলবেন।
চাকসু নির্বাচনে অমোচনীয় কালির বদলে পারমানেন্ট মার্কার : চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের হাতে যে কালি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি অমোচনীয় নয়। এমন অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও সমাজসেবা ও পরিবেশ বিষয়কসম্পাদক পদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হাসিবুর রহমান রনি। তারা বলছেন, এতে ভোটে জালিয়াতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নোমান জানান, তারা এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনারের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। অন্যদিকে হাসিবুর দাবি করেন, আইটি অনুষদের ২১৪ নম্বর কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারের সইবিহীন ২০টি ব্যালট পেপার জমা পড়ে। এ বিষয়ে আইটি অনুষদের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক এস এম শরিফুজ্জামান বলেন, দেশে বর্তমানে কোনো স্থায়ী ভোটের কালি পাওয়া যায় না। সে কারণেই ভোটের পর পারমানেন্ট মার্কার ব্যবহার করা হয়। সইবিহীন ব্যালটের বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি নজরে এসেছে এবং নির্বাচন শেষে তা সংশোধন করা হবে।
দেশে কোথাও অমোচনীয় কালি পাইনি - চাকসু সিইসি : চাকসু নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) অধ্যাপক মনির উদ্দিন বলেন, দেশে কোথাও অমোচনীয় কালি পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, আমরা সব জায়গায় খুঁজেছি। আমরা তো নির্বাচন কমিশনের অফিসেও গিয়েছিলাম। কিন্তু অমোচনীয় কালি খুঁজে পাইনি।
চাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের জন্য রিহার্সাল- চবি উপাচার্য : চাকসু নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেন উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার। ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন শেষে উপাচার্য বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিতকরণে সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের জন্য রিহার্সাল হিসেবে বিবেচিত হবে। তিনি বলেন, এটি শিক্ষার্থীদের নির্বাচন, তারা এটি অধীর আগ্রহে ছিল। নির্বাচনী প্রচারণা চমৎকারভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কারও পথে বাধা আসেনি। আচরণবিধি মেনে তারা নির্বাচনের জন্য বন্ধুসুলভ পরিবেশ বজায় রেখেছে। ‘যেকোনো নির্বাচনের জন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও অনুকূল পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই স্বীকৃতি শিক্ষার্থীদেরই পাওয়া উচিত,’ বলেন উপাচার্য। উপ-উপাচার্য অধ্যাপক কামাল উদ্দিন বলেন, ভোট গণনার জন্য ওএমআর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, যেন কোনো সময় নষ্ট না হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনি যদি জানতে চান, আমরা ডাকসু নির্বাচন শতভাগ অনুসরণ করেছি কি না- না, আমরা তা করিনি। তবে আমরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি এবং তারা যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল তা সমাধানের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করেছি।
ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়া জন্য ১১ জোড়া শাটল ১৫ জোড়া বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা : শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়াতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচনের জন্য সকাল থেকে ১১ জোড়া শাটল ট্রেন ও ১৫ জোড়া বাস সার্ভিসের বিশেষ ব্যবস্থা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
চাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ২৭ হাজার ৫১৭ জন। এসব ভোটারের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে চট্টগ্রাম নগরীতে। ভোটের দিন নির্বিঘ্নে তাদের যাতায়াতের কথা মাথায় রেখেই স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি শাটল ট্রেন ও বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হয়।