
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি)। গতকাল সোমবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ দাবি করেন। মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত। নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপক দুর্বলতা এই ঘটনার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের বিপরীতে বিমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তি করার দাবি জানাচ্ছি। যেসব পণ্য বিমার বাইরে রয়েছে, তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ তহবিল গঠন করে ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আগুনে ৩২টি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আশঙ্কা করছি সামনের দিনগুলোতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের তথ্য সঠিকভাবে সংগ্রহ করে ইএবি’র সঙ্গে শেয়ার করতে, যাতে ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়।
তিনি বলেন, এই ধরনের ঘটনায় শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, দেশের রপ্তানি খাতের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, আগুনে বিপুল পরিমাণ আমদানি-রফতানি পণ্য ধ্বংস হয়েছে এবং এতে দেশের রফতানি খাতের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের দ্রুত বিমা দাবি নিষ্পত্তি ও সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
কার্গো ভিলেজে আগুনে ২০০ কোটি টাকার ওষুধের কাঁচামাল পুড়েছে : রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব মো. জাকির হোসেন বলেছেন, ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ওষুধের কাঁচামাল পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৩০৭টি ওষুধ কোম্পানি আছে। এর মধ্যে ২৫০ কোম্পানি সচল আছে। শীর্ষস্থানীয় ৩২ কোম্পানি জানিয়েছে, তাদের ২০০ কোটি টাকার বেশি কাঁচামাল পুড়ে গেছে। বাকি কোম্পানিগুলো হিসাব দিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব বলেন, একেকটি ওষুধ উৎপাদনে ১০-১২টি থেকে ৫৩টি উপকরণের প্রয়োজন হয়। ফলে ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ার কারণে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। তবে এখনই সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। জাকির হোসেন বলেন, শনিবার আগুনের সময় অনেক বিমান চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেসব বিমানে থাকা ওষুধের কাঁচামাল শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক থাকবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা আছে। কেননা ওষুধের কাঁচামাল সংরক্ষণে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি বিষয়। সেখানে এই ব্যবস্থা নেই। মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কার্গো ভিলেজের আগুনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, কার্গো ভিলেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন শনাক্ত ও প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা : বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের তিন দিন পার হলেও এখনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত সিএনএফ এজেন্ট ও আমদানিকারকরা। আগুনে কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যাওয়ায় ব্যবসায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। গতকাল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে লাগা আগুনের ঘটনাস্থলে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, কার্গো ভিলেজের পুড়ে যাওয়া ভবন থেকে আর ধোঁয়া উঠছে না। ভবনের সামনে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি মোতায়েন রয়েছে এবং কয়েকজন কর্মী ভেতরে কাজ করছেন। পুরো এলাকা পুলিশ ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তায় ঘেরা। কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। আরও দেখা যায়, ভবনের সামনে ফুটপাতে অবস্থান করছেন বিভিন্ন সিএনএফ এজেন্ট ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গত রোববারের তুলনায় গতকাল উপস্থিতি কিছুটা কম হলেও তাদের মুখে হতাশা স্পষ্ট। তারা এখনও ভাবছেন, কীভাবে ক্ষতিপূরণ পাবেন এবং নতুন করে আগত শিপমেন্টগুলো কীভাবে নিরাপদে সরানো যাবে। সিএনএফ এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা শুধু বর্তমান ক্ষতির কথা ভাবছে না, ভবিষ্যতেও এই আগুনের প্রভাব থাকবে। সরকার যদি আর্থিক সহায়তা দেয়, তাহলে হয়ত ব্যবসা স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারবেন বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে টেলি বাংলাদেশ নামের সিএনএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক নাসির উদ্দিন বলেন, ভারত ও চায়না থেকে আমরা গার্মেন্টস শিল্পের জন্য সুতা নিয়ে আসি। আগুনে আমাদের ৪৫টি শিপমেন্ট পুড়ে গেছে, যার বাজারমূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। এর বেশিরভাগই স্যাম্পল ছিল। গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ায় রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। কারণ এসব কাঁচামাল দেশের বাজারে বিক্রি করা হয় না—বিভিন্ন পোশাক কারখানা এগুলো দিয়ে তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানি করে। তিনি আরও বলেন, এই সুতা দিয়ে বিদেশি অর্ডারের সোয়েটার তৈরি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন শিপমেন্টগুলো পুড়ে যাওয়ায় সেই অর্ডার বাতিলের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে শুধু আমদানিকারকই নয়, আমরা সিএনএফ এজেন্ট, এমনকি পোশাক কারখানার কর্মচারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারি সহায়তা দাবি করে তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছি। পাশাপাশি দ্রুত একটি কার্গো ভিলেজের বিকল্প সংরক্ষণাগার তৈরিরও অনুরোধ করেছি, যেখানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকবে। এখনকার মতো বাইরে মালামাল রাখলে তা বৃষ্টি ও অতিরিক্ত তাপে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অন্যদিকে সিএনএফ এজেন্ট কোম্পানি ইমুট্রান্স বাংলাদেশ লজিস্টিক্স লিমিটেডের ম্যানেজার (আমদানি-রপ্তানি শাখার ইনচার্জ) হাসান জানান, তাদের চারটি ডকুমেন্টসহ প্রায় ১৩ হাজার ডলারের কনসাইনমেন্ট পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, এত বড় শিপমেন্ট হওয়ায় এটি ইনস্যুরেন্স করা ছিল বলে আশা করছি। সাধারণত বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারি ও ইকুইপমেন্ট ইনস্যুরেন্সের আওতায় থাকে। ইনস্যুরেন্স থাকলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইনের অধীনে কোম্পানি ক্ষতিপূরণ বহন করবে। তবে এখনো বায়ারদের কাছ থেকে ক্লেইম বা প্রতিক্রিয়া পাইনি। আমরা চাই সরকার আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। না হলে আমরা স্বাভাবিকভাবে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবো না। কারণ এই আগুনের দীর্ঘ মেয়াদি একটা প্রভাব পড়বে একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ওপর।
প্রসঙ্গত, গত শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং বিজিবি যৌথভাবে সাত ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে শতাধিক আমদানি-রপ্তানি পণ্য, গার্মেন্টসের কাঁচামাল ও বিভিন্ন কনসাইনমেন্ট সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়।