ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নির্বাচন কমিশন অন্যায় চাপের কাছে নতিস্বীকার করবে না : সিইসি

নির্বাচন কমিশন অন্যায় চাপের কাছে নতিস্বীকার করবে না : সিইসি

নির্বাচন কমিশন কারো কোনো অন্যায় চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেন তিনি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত (টিওটি) এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিইসি বলেন, আমরা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। আমাদের দেশের দুরবস্থার একটি মূল কারণ হলো, আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নই। ‘যে জাতি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল যত বেশি, সেই জাতি তত সভ্য বলে আমরা মনে করি। সভ্য দুনিয়া কিন্তু আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে।’

কালচার নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এই কালচারটা কালটিভেট করতে হবে। উই ওয়ান্ট রুল অব ল, নট রুল বাই ল। শাসন করার জন্য বানালাম, সেটা না। আমরা চাই, সর্বস্তরের সবাই আমরা আইন মেনে চলব, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকব।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, একটা সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে আমরা চেষ্টা আমরা করব। আপনাদের নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পড়বে। যে দায়িত্ব পড়ুক না কেন, সেটা আপনারা ন্যায়সম্মতভাবে, আইনসম্মতভাবে, নিউট্রালি ও প্রফেশনালি পালন করবেন।

এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, নির্বাচনের মধ্যে সমন্বয় একটা বড় জিনিস। আপনারা যেহেতু উপজেলা পর্যায়ে নিয়োজিত, সমন্বয়ের দায়িত্বটা মূলত আপনাদের ওপরই নির্ভর করে। নির্বাচনের সময় সমন্বয়টা খুবই জরুরি।

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়, প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসারের সঙ্গে সমন্বয়, কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল, জেলা মনিটরিং সেল, ইলেকশন মনিটরিং সেলের সঙ্গে সমন্বয়- এই সার্বিক সমন্বয়টা আপনাদের খুব সিরিয়াসলি পারসিউ করতে হবে।

নাসির উদ্দিন বলেন, আপনারা কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না এবং সম্পূর্ণভাবে আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন। আমাদের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা থাকবে। নির্বাচন কমিশনও কিন্তু কারো কোনো অন্যায় চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। সুতরাং আমরা আপনাদের অন্যায় কোনো আদেশ দেব না। অন্যায় কোনো হুকুম দেব না।

তিনি বলেন, মোবাইল ম্যাজিস্ট্রেসি অনেক ঘটনায় দেখা যায় হয়তো, এভরিথিং ইজ ওভার, সবকিছু শেষ হওয়ার পরে পৌঁছায়। তখন দেখবেন যে আর কেউ নাই। সবাই মারামারি করে ভোটের কেন্দ্র দখল করে, বাক্স দখল করে বাড়ি চলে গেছে, আর আপনি গিয়ে হাজির হলেন, সেটা যাতে না হয়, তা আপনাদের নিশ্চিত করতে হবে।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অনুষ্ঠানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) উদ্দেশে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেছেন, ‘আপনি আমেরিকা থেকে পিএইচডি করে আসছেন, কানাডা থেকে লেখাপড়া করে আসছেন, আপনি বিসিএস পাস করেছেন, ভুলে যান। আপনি জনগণের চাকর। সোজা কথা, সবার সাথে মিশতে হবে।’ ইসি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথম কথা হলো সামনে যে নির্বাচন, এই নির্বাচন নিয়ে কি আমরা খুব ভয় পাচ্ছি? ভয়ের কোনো কারণ নেই। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কিছুদিন প্রশাসন খুব দোদুল্যমান ছিল। খুব কঠিন সময় পার করেছেন আপনারা, কোনো সন্দেহ নেই। এখন মোটামুটিভাবে উপজেলা পর্যায়ের যে সমস্যাগুলো, অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন।’

তিনি বলেন, ‘তাহলে আপনাদের (ইউএনও) ভয় নাই। এখনকার পর্যায়ে সবচেয়ে ক্ষমতাবান অফিসার কে? উপজেলা নির্বাহী অফিসার। এটা আপনি চেয়ারে আপনি হয়তো টের পান না।’

এই কমিশনার বলেন, ‘আপনাদের অনেকে হয়তোবা মনে করতে পারেন, সামনে কী অবস্থা। আজকের এক পত্রিকায় দেখলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবহ সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন থেকে আপনাদের প্রতি মেসেজ হলো, কোনো ভয় নেই। সঠিক কাজ করবেন, নির্বাচন কমিশন আপনাদের সঙ্গে আছে।’ ‘কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কাজ করলে কিন্তু সাংঘাতিক পেরেশানিতে পড়বেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে যদি অন্যায়ভাবে কোনো কাজ হয়ে যায়, কিন্তু ইল ইনটেনশনে যদি আমরা ফিল্ড লেভেলে কোনো সমস্যার সৃষ্টি করি, পার পাবেন না। আর সঠিকভাবে কাজ করার জন্য যা যা লাগে, অর্থায়ন লাগে, সেটাও আপনাকে দেব।’

তিনি বলেন, ‘আপনারা তারা, যাদের নেতৃত্ব, যাদের সমন্বয়, যাদের বুদ্ধিমত্তা, যাদের সততা, যাদের নিষ্ঠা, নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করবে সামগ্রিক নির্বাচনের অবস্থা। ইউএনওর ভূমিকা এমন হবে যে প্রত্যেকেই মনে করবেন, ইউএনও সাহেব আমার লোক। কিন্তু আপনি কিন্তু কারো লোক নন।’

ইসি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মান-সম্মান যে ভূলণ্ঠিত হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর মধ্যে আমিও একজন। সুতরাং আমাদের যে সুযোগটি এসেছে এটি কাজে লাগাতে হবে। কারণ এখন যে সরকার, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে এটি স্বাভাবিক এবং এই সময়ে আপনার সততার নিষ্ঠা দেখানোর সুযোগ।’

নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, প্রবাসী ভোটারদের জন্য পোস্টাল ভোটবিডি অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন প্রক্রিয়া ১৬ নভেম্বর থেকে শুরু হতে পারে বলে জানান।

পোস্টাল ব্যালট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটাকে আমরা অনলাইনে নিয়ে গিয়েছি। সেই অপ্লিকেশনটা এই মুহূর্তে ট্রায়াল রানে আছে। আশা করছি, নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি ১৬ নভেম্বর আমাদের প্রত্যাশা এই অ্যাপ্লিকেশনটা সবার ব্যবহারের জন্য লঞ্চ করে দেব।’ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪৩৫ জন পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের উদ্দেশে এই কমিশনার বলেন, ‘এই নির্বাচনকে সামনে রেখে আশা করব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রথম অবস্থায় দুই হাজার ৭০০ জন ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে কাজ করেন। নির্বাচন যখন কাছে চলে আসে, তখন এই সংখ্যাটা গিয়ে তিন হাজারের উপরে উঠে যায়। কিন্তু, কার্যকরীভাবে মাঠপর্যায়ে দেখা যায় অনেকে সময়টা দেন না।’

নির্বাচনকে প্রায়োরিটি হিসেবে নিয়ে দায়িত্ব পালনের আবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এবার যেন আমরা এই নির্বাচনের গুরুত্বটা উপলব্ধি করি। আমাদের সব কাজ থাকলেও এটাকে প্রায়োরিটি কাজ হিসেবে নিয়ে যেন আমাদের দায়িত্বটা পালন করি মাঠ পর্যায়ে, এটা আপিল। প্রশাসন কঠোরভাবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করে যাবে এই আবহাওয়াটা তৈরি করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভালোভাবে করতে না পারলে বিশ্ব, মানুষ এবং জাতির কাছে আমরা অত্যন্ত নিন্দিত জাতি হিসেবে পরিণত হব বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আব্দুর রহমানেল মাছউদ। তিনি বলেন, ভালো নির্বাচন করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সুন্দর, সুষ্ঠু ও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে হবে। ইসি মাছউদ বলেন, আমরা যারা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য আইনগতভাবে বাধ্য ছিলাম, তারা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতাম তাহলে কি জাতিকে এই নির্মম পরিণতি দেখতে হতো? পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি, যদি তাদের এই পরিণতি না হয়। তবে এক জাতি, এক দেশ হয়েও কেন আমরা পারবো না? নির্বাচনের দায়িত্বকে তিনি পবিত্র আমানত হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমানতের খেয়ানত যে করে, সে মুনাফেক। অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করাই হলো আমাদের আমানত। এটাই সকল ধর্মের মূল নীতিকথা।’

ইসি মাছউদ আরও বলেন, ‘প্রত্যেকে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে সকল প্রতিকূলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে সুন্দর, সুষ্ঠু এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হব।’ এতে ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদের সভাপতিত্ব প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন।

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন নির্বাচন কমিশনার বেগম তাহমিদা আহমদ, নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার এবং নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত