ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মন্ত্রণালয়ের হুঁশিয়ারি

পরীক্ষা বন্ধ, স্কুলে তালা ঝুলিয়ে ‘শাটডাউন’

* শিক্ষকরা পরীক্ষা বন্ধ রাখায় শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ * পরীক্ষা না নিয়ে কর্মসূচি চালালে ব্যবস্থা, বলল মন্ত্রণালয় * তিন শিক্ষককে শোকজ, আন্দোলন চললে ফৌজদারি মামলা * দাবি বাস্তবায়ন ছাড়া স্কুল খোলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি : আহ্বায়ক মো. আনোয়ার উল্যাহ
পরীক্ষা বন্ধ, স্কুলে তালা ঝুলিয়ে ‘শাটডাউন’

বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ রেখে তিন দফা দাবি আদায়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। গতকাল বুধবার সকাল থেকে সারাদেশে স্কুলের ফটক ও শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন তারা। হঠাৎ করে শিক্ষকদের এমন সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। কমলমতি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা আকস্মিক কর্মসূচিতে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও শিক্ষকরা জানিয়েছেন- তাদের দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। একই সঙ্গে সহকারী শিক্ষকরা নিজ নিজ উপজেলা বা থানা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার (এটিইও) কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। সরেজমিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্কুলে ঘুরে দেখা যায়, ময়মনসিংহ নগরের শাঁখারীপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে, তাই প্রস্তুতি নিয়ে স্কুলে এসেছিল শিশু শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এসে দেখে শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলছে। পরে বাধ্য হয়ে অভিভাবকের অপেক্ষায় তালাবদ্ধ কক্ষের বাইরে বসে থাকে শিক্ষার্থীরা। দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা মেহের বলেন, ‘আমাদের বাংলা পরীক্ষা ছিল। কিন্তু ম্যাডামদের কর্মবিরতির কারণে পরীক্ষা হচ্ছে না। ক্লাস রুমেও তালা, তাই বসে আছি। মা আসলেই বাসায় যাবো।’ সায়ন্তী মনি নামে প্রথম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী বলেন, পরীক্ষা না হওয়ায় বসে রয়েছি। ম্যাডামরা ক্লাসে আসছে না। মা আমাকে রেখে বাসায় চলে যাওয়ায় যেতেও পারছি না। শুধু শাঁখারীপট্টির স্কুল নয় গতকাল বুধবার সকাল থেকে ক্লাস বন্ধ করে বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেন দেশের অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা।

ময়মনসিংহ শাঁখারীপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল নাহার বলেন, ‘আমাদের বেতন স্কেল দশম গ্রেডে নির্ধারণ, ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির বিষয়ে জটিলতার অবসান, সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির দাবিতে বাধ্য হয়ে শাটডাউন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা শিক্ষার্থীদের কষ্ট দিতে চাই না। সরকার দাবি মেনে নিলেই ক্লাসে ফিরব।’ ময়মনসিংহ নগরের সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খাদিজাতুল কোবরা বলেন, ‘সফল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবেই। আমরা আমাদের দাবিতে অনড়।’ ময়মনসিংহ গোহাইলকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সারমিন সুলতানা বলেন, ‘সকালে আমরা প্রত্যেকটি শ্রেণি কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছি। ছাত্ররা এসে স্কুল থেকে ঘুরে গেছে। তবে আমাদের দাবির ব্যাপারে সকলেই সহমত।’ শাঁখারীপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লিপি মনিকর বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন করায় একা পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে কর্মবিরতি প্রত্যাহার হলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া হবে।’

ময়মনসিংহের মতোই মেহেরপুরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফটক ও শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন আন্দোলনরত সহকারী শিক্ষকেরা। সকালে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ফটক, অফিসকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলে থাকায় তারা ভেতরে ঢুকতে পারেনি। অনেকে অভিভাবকের সঙ্গে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। গাংনী উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আজমাইল হোসেন বলে, ‘পরীক্ষা দিতে এসে দেখি কক্ষে তালা ঝুলছে। এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’ নওপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হামিদুল ইসলাম বলেন, শিক্ষক নেতারা বলেছেন পরীক্ষা বন্ধ রাখতে। এ কারণে পরীক্ষা হচ্ছে না। গাংনী উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম জয়নুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। নির্দেশনা পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সারাদেশে বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে পরীক্ষা বন্ধ ছিল। তবে কিছু বিদ্যালয়ে পরীক্ষা চললেও সহকারী শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন না। তেমনি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার ধর্মপাশা ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজমুল হায়দার ও মধ্যনগর উপজেলার সাউদপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ২ ডিসেম্বর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সহকারী শিক্ষকেরা কর্মবিরতিতে থাকায় প্রধান শিক্ষকেরা কোনো রকমে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা চালিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু এতে সমস্যা হচ্ছে। একই অবস্থা ঢাকার অনেক বিদ্যালয়ে। নীলক্ষেত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শিশুরা পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রধান শিক্ষক জান্নাতুল নাঈমা বলেন, তাদের বিদ্যালয়ে সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা হচ্ছে। ১০ ডিসেম্বর শেষ হবে পরীক্ষা। একই দাবিতে সহকারী শিক্ষকদের আরেকটি সংগঠন ‘সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে ২৩ থেকে ২৭ নভেম্বর কর্মবিরতি পালন করেছিল। ঐক্য পরিষদের একজন আহ্বায়ক মো. আনিসুর রহমান বলেন, আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) থেকে তারাও বিদ্যালয়ে ‘তালাবদ্ধ’ কর্মসূচি শুরু করবেন।

সহকারী শিক্ষকদের ৩ দফা দাবি : সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা, ২. ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা দূর করা এবং ৩. সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি নিশ্চিত করা।

শিক্ষকরা পরীক্ষা বন্ধ রাখায় শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ : দাবি আদায় করতে অসংখ্য স্কুলে শিক্ষকরা তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এতে চলমান বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। পরীক্ষা দিতে না পারায় বরিশাল নগরের ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। নগরের গির্জামহল্লা সড়কে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেওয়ার দাবি জানিয়ে স্লোগান দিতে দেন। এ সময় সড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যানজটের সৃষ্টি হলে পথচারীরা ভোগান্তিতে পড়েন। পরে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেয় এবং অভিভাবকদের সহায়তায় পরীক্ষা শুরু হয়। ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা আঞ্জুমান আরা জানান, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পর পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। তবে এতে কোনো সহকারী শিক্ষক সহায়তা করেননি।

জানা গেছে, চলমান শিক্ষক আন্দোলনের ঘটনায় প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক খায়রুন নাহার লিপি, পরিষদের অন্য তিন আহ্বায়ক বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও নোয়াখালী সদরের কৃপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. শামছুদ্দীন মাসুদ, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার চানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আবুল কাশেম এবং প্রাথমিক শিক্ষক দশম গ্রেড বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়ক ও জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মাহবুবার রহমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

পরীক্ষা না নিয়ে কর্মসূচি চালালে ব্যবস্থা, মন্ত্রণালয়ের হুঁশিয়ারি : বুধবার বিকেলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ শিবলী সাদিকের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, লাগাতার কর্মবিরতি ও বার্ষিক পরীক্ষা বর্জনের পর ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছেন দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। এতে তৃতীয় প্রান্তিক বা বার্ষিক পরীক্ষায় চরম বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অবিলম্বে পরীক্ষা নেওয়ার কাজে অংশ নিতে শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপরও কেউ পরীক্ষা না নিয়ে কর্মবিরতি বা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চালিয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে সরকারি চাকরি আইন, আচরণ বিধিমালা ও ফৌজদারি আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়।

প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের অন্যতম আহ্বায়ক মো. আনোয়ার উল্যাহ বলেন, আমরা বাধ্য হয়েই শাটডাউনে গেছি। ২২ দিন ধরে প্রতিশ্রুতির অগ্রগতির অপেক্ষায় ছিলাম, কিন্তু কোনো বাস্তব পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। সহকারী শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি বাস্তবায়ন ছাড়া স্কুল খোলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আমরা চাই সমস্যা দ্রুত সমাধান হোক, শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে ফিরুক, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা স্বাভাবিক হোক। কিন্তু সেই সুযোগ তৈরি করা এখন সরকারের দায়িত্ব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত