প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সব মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই।’ (সুরা হুজরাত : ১০)। এক মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের তাই করণীয় কিছু বিষয় রয়েছে। সেগুলো হলো-
সালাম দেওয়া : পরিচিত অপরিচিত সকল মুসলিমকে সালাম দেওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে মানুষ! তোমরা সালাম প্রচার করো, অন্নদান করো এবং লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামাজ পড়ো; তাহলে নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।’ (তিরমিজি : ২৪৮৫)।
রোগীর খোঁজখবর নেওয়া : কোনো মুসলিম যদি অসুস্থ হয়, তাহলে তার খোঁজখবর নেওয়া, সেবা-শুশ্রুষা করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রোগী দেখতে যাও এবং জানাজায় অংশগ্রহণ করো। কেননা তা তোমাদের পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৩/৪৮)।
হাদিয়া গ্রহণ করা : কোনো মুসলিম হাদিয়া দিলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা গ্রহণ করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা যদি খুশি হয়ে তোমাদের দেয়, তাহলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করো।’ (সুরা নিসা : ৪)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার কাছে যদি একটি পা অথবা বাজুও হাদিয়া হিসেবে পাঠানো হয়, তবুও আমি তা গ্রহণ করব।’ (বোখারি : ২৪২৯)।
হাঁচির জবাব দেওয়া : রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা হাঁচি দেওয়া পছন্দ করেন, আর হাই তোলা অপছন্দ করেন। যদি তোমাদের কেউ হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে, তাহলে প্রত্যেক শ্রোতার জন্য আবশ্যক হলো, তার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা।’ (বোখারি : ৬২২৬)।
দাওয়াত গ্রহণ করা : কোনো মুসলিম দাওয়াত দিলে তা গ্রহণ করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যাকে দাওয়াত দেওয়া হয়, সে যেন তা গ্রহণ করে। (মুসলিম : ৩৫৮৭)। আরেক হাদিসে এসেছে, ‘যখন তোমাদের কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয় (কোনো আপত্তিকর ব্যাপার না থাকলে), তখন সে যেন তা গ্রহণ করে। সে যদি রোজাদার হয়, তাহলে যেন তার (দাওয়াতকারীর) জন্য দোয়া করে দেয়; আর যদি রোজাদার না হয়, তাহলে যেন সে খেয়ে নেয়।’ (মুসলিম : ৩৫৯৩)।
সহযোগিতা করা : কোনো মুসলিমের সাহায্যের প্রয়োজন হলে তাকে সাহায্য করা। সাহায্য বহুভাবে হতে পারে। কথা দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, শক্তি দিয়ে, সম্পদ, অন্ন, বস্ত্র ইত্যাদি দিয়ে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজখবর নাও, বস্ত্রহীন লোকদের বস্ত্র দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করে দাও।’ (বোখারি : ২৪১৭)। আরেক হাদিসে এসেছে, ‘বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।’ (মুসলিম : ২৫৬৬)।
সদয় হওয়া : মুসলিমদের সঙ্গে সদয় হওয়া। কোমল আচরণ করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা জগদ্বাসীর প্রতি সদয় হও, তাহলে আসমানের মালিক আল্লাহতায়ালা তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’ (তিরমিজি : ১৮৪৭)। তিনি আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে।’ (বোখারি : ১৭৩২)।
পরামর্শ চাইলে দেওয়া : কোনো মুসলিম পরামর্শ চাইলে তাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘(কোনো মুসলিম) তোমার কাছে পরামর্শ চাইলে তুমি তাকে ভালো পরামর্শ দেবে।’ (মুসলিম : ২১৬২)। মোল্লা আলী কারি (রহ.) বলেন, ‘কোনো মুসলিম পরামর্শ চাইলে পরামর্শ দেওয়া আবশ্যক। পরামর্শ না চাইলেও কল্যাণকর বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া উচিত।’ (মেরকাত : ৫/২১৩)।
সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরাই হলে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। মানবজাতির কল্যাণে তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে বাঁধা প্রদান করবে। আর আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১১০)।
ব্যথায় ব্যথিত হওয়া : মুসলিমের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া। কোনো কারণে যদি কোনো মুসলিম আক্রান্ত হয়, তাহলে দুঃখিত হওয়া, সমবেদনা জানানো এবং তাকে উদ্ধার করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সব মোমিন এক দেহের মতো। যখন তার চোখে যন্ত্রণা হয়, তখন তার পুরো শরীরই তা অনুভব করে। যদি তার মাথাব্যথা হয়, তাতে তার পুরো শরীরই বিচলিত হয়ে পড়ে।’ (মুসলিম : ২৫৮৬)।
সম্মান রক্ষা করা : কোনো মুসলিমের সম্মানহানি না করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুসলমান কারো খেয়ানত করবে না। কেউ কারও সঙ্গে মিথ্যা বলবে না এবং কেউ কারও সহযোগিতা থেকে দূরে থাকবে না। প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত, ধন-সম্পদ ও মান-মর্যাদা অন্য মুসলমানের জন্য হারাম।’ (তিরমিজি : ১৯২৭)।
সম্পদ রক্ষা করা : মুসলিমদের সম্পদ রক্ষা করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পদের কিয়দাংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশে তা বিচারকের কাছে পেশ করো না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)।
আমানত রক্ষা করা : কোনো মুসলিমের আমানতের খেয়ানত না করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতকে তার মালিকের কাছে ফেরৎ দাও।’ (সুরা নিসা : ৫৮)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যার আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই।’ (মুসনাদে আহমদ : ১২৫৬৭)।
জীবন রক্ষা করা : মুসলিমের জীবন রক্ষা করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করো না।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩৩)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার চেয়ে একজন মুসলিমের খুন হওয়া গুরুতর।’ (তিরমিজি : ১৩৯৫)।
সুপারিশ গ্রহণ করা : কোনো মুসলিমের জন্য সুপারিশ প্রয়োজন হলে সুপারিশ করা এবং সুপারিশ করলে তা গ্রহণ করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা সুপারিশ করো, তাহলে তোমাদের সুপারিশের সওয়াব দেওয়া হবে।’ (বোখারি : ৬০২৬)। তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অপরের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার একশত প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন। আর বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।’ (মুসলিম : ২৫৬৬)।
কসম পূর্ণ করা : কোনো মুসলিম ন্যায়সঙ্গত কসম করলে তা পূর্ণ করার জন্য তাকে সাহায্য করা। বারা ইবনে আজেব (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের সাতটি বিষয় করতে নির্দেশ দিয়েছেন, আর সাতটি বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন। এরপর তিনি উল্লেখ করেন, ‘রোগীর শুশ্রুষা করা, জানাজার সঙ্গে চলা, হাঁচির উত্তর দেওয়া, সালামের জবাব দেওয়া, মজলুমকে সাহায্য করা, দাওয়াত কবুল করা এবং কসমকারীর কসম পূরণ করা। (অর্থাৎ আল্লাহর কসম বা দোহাই দিয়ে কেউ কিছু বললে বা দাবি করলে তা পূরণে সহায়তা করা)।’ (বোখারি : ২৪৪৫)।
নির্যাতিত হলে উদ্ধার করা : কোনো মুসলিম নির্যাতিত হলে অন্য মুসলিমদের জন্য তাকে সাহায্য করা আবশ্যক। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা জালিম সম্প্রদায়ের মোকাবিলায় তোমাদের সাধ্যানুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করো।’ (সুরা আনফাল : ৬০)।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমার ভাইকে সাহায্য করো; সে জালেম হোক বা মজলুম।’ আনাস (রা.) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! মজলুমকে সাহায্য করব, তা তো বুঝলাম; কিন্তু জালেমকে কী করে সাহায্য করব?’ তিনি বললেন, ‘তুমি তার হাত ধরে তাকে বিরত রাখবে।’ (বোখারি : ২৪৪৪)।
ডাকে সাড়া দেওয়া : কোনো মুসলিম ডাকলে সাড়া দেওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘এক মুসলিমের ওপর অন্য মুসলিমের ছয়টি অধিকার রয়েছে।’ বলা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তা কী কী?’ তিনি বললেন, ‘মুসলিমের সঙ্গে তোমার দেখা হলে সালাম দেবে। তোমাকে ডাকলে সাড়া দেবে।’ (মুসলিম : ২১৬২)।
ভালোবাসা : সব মুসলিমকে ভালোবাসা। ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধন হলো, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। পরস্পর ভালোবাসা স্থাপন না করা পর্যন্ত তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না।’ (মুসলিম : ৮১)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘মোমিনগণ পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক দেহের মতো। দেহের কোনো অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে পুরো দেহ সে ব্যথা অনুভব করে।’ (বোখারি : ৬০১১)।
কল্যাণ কামনা করা : সব মুসলিমের কল্যাণ কামনা করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দ্বীন হলো কল্যাণকামিতা।’ (মুসলিম : ৫৫)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য করে।’ (বোখারি : ১৩)।
বিবাদ মীমাংসা করা : কোনো কারণে মুসলিমদের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ হলে তা মীমাংসা করে দেওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের রোজা-নামাজ ও সদকার চেয়েও উত্তম বিষয়ের খবর দেব কী? (তাহলে শোনো) তা হলো, পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসা করে দেওয়া। কেননা পরস্পরের বিবাদ দ্বীনকে মিটিয়ে দেয়।’ (তিরমিজি : ২৫০৯)।
দোষ চর্চা না করা : কোনো মুসলিমের দোষ চর্চা না করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাকো। কারণ অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ। আর তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না।’ (সুরা হুজরাত : ১২)।
হিংসা-বিদ্বেষ না করা : কোনো মুসলিমের সঙ্গে হিংসা-বিদ্বেষ না করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। তাই তোমরা পরস্পরকে হিংসা করো না, ঈর্ষান্বিত হয়ো না, কারও পেছনে লেগো না; বরং তোমরা এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে একে অপরের ভাই হয়ে যাও।’ (বোখারি : ৫৬৩৮)।
তিনদিনের বেশি কথা বন্ধ না রাখা : কোনো মুসলিমের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে তিনদিনের বেশি কথাবার্তা বন্ধ না রাখা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা পরস্পর সম্পর্কচ্ছেদ করো না, একে অন্যের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হয়ো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও। কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইয়ের সঙ্গে তিনদিনের বেশি কথাবার্তা বন্ধ রাখা বৈধ নয়।’ (বোখারি : ৬০৫৬)।
জানাজায় শরিক হওয়া : কোনো মুসলিম মৃত্যুবরণ করলে তার দাফন-কাফন ও জানাজায় শরিক হওয়া। রাসুল (সা.) এক মুসলিমের ওপর অন্য মুসলিমের ছয়টি অধিকারের কথা বলেছেন। এর ছয় নম্বরটি হলো, ‘কোনো মুসলিম মৃত্যুবরণ করলে তার জানাজায় শরিক হবে।’ (মুসলিম : ২১৬২)।