সয়াবিন তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার কৃষকরা। মাঠের পর মাঠ জুড়ে সয়াবিন গাছ কাটা হচ্ছে, শুকানো হচ্ছে শুঁটি। তবে চেহারায় উচ্ছ্বাস নেই, বরং দেখা যাচ্ছে ক্লান্তি আর উদ্বেগ। কারণ, এ বছরের ফলন আশানুরূপ হয়নি এবং বাজারেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত দাম। কৃষকেরা বলছেন, সবমিলিয়ে তারা এবার লোকসানের মুখে পড়েছেন। রায়পুরে চলতি রবি মৌসুমে ৭ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ হয়েছে, যা পূর্বের বছরের চেয়ে বেশি। কৃষি বিভাগ বলছে, আবাদে লক্ষ্য ছাড়িয়ে গেলেও ফলন নিয়ে সন্তুষ্ট নন অনেকে। মৌসুমের শুরুতে খরার কারণে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। অনেক গাছেই শুঁটি এসেছে কম, আবার যেগুলো এসেছে, সেগুলোর দানাও ছোট।
স্থানীয় কৃষক ইউনুস মিয়া বলেন, ‘সঠিক সময়ে বৃষ্টি হইলে গাছ বড় হইতো, শুঁটিও বেশি দিতো। কিন্তু এখন ফলন কম, দানা ছোট। খরচ উঠাইতেই হিমশিম খাইতেছি।’ একই কথা বলেন কৃষক আমিনুল হক। তিনি জানান, প্রতি বিঘায় তার খরচ হয়েছে প্রায় ৯ হাজার টাকা, অথচ ফলন এসেছে ৬ মণের নিচে। বর্তমান বাজার দামে তা দিয়ে খরচই উঠছে না। লক্ষ্মীপুর জেলা দেশের সয়াবিন উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ যোগান দেয়। এই অঞ্চলের উঁচু ও মধ্যম টেরেনের জমি সয়াবিন চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় প্রতিবছর কৃষকেরা এখানে সয়াবিনকে অর্থকরী ফসল হিসেবে বেছে নেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘যারা নিয়ম মেনে চাষ করেছেন, তারা তুলনামূলক ভালো ফলন পেয়েছেন। কিন্তু অনেকেই জমির যত্নে ঘাটতি রেখেছেন। আর মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় দানার আকার ছোট হয়েছে।’ তিনি জানান, দাম মৌসুমের শুরুতে একটু কম থাকে, তবে কিছুদিন পর তা বাড়বে বলেই কৃষি বিভাগের প্রত্যাশা। বর্তমানে প্রতি মণ সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায়।
কৃষকরা বলছেন, এই দামে বিক্রি করে কোনো লাভ তো নেই, বরং মূলধনই উদ্ধার করা যাচ্ছে না। রায়পুরের পাইকারি হাটের ব্যবসায়ী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছরের কিছু সয়াবিন এখনো গুদামে পড়ে আছে। বাজারে চাহিদা কম, দাম বাড়ানোর উপায়ও নেই। তেলের বাজারও কড়া প্রতিযোগিতার মধ্যে আছে।’ অন্যদিকে কৃষকদের দাবি, সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ না থাকায় মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভর করেই ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে। কৃষক হুমায়ুন বলেন, ‘সরকার যদি ধানের মতো সয়াবিনও কিনতো, তাহলে অন্তত দাম নিয়ে এত কষ্ট হতো না। এখন ফড়িয়া যা দেয়, তাই নিতে হয়।’ সয়াবিন চাষ এই অঞ্চলে শুধু চাষ নয়, এটা অনেক পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস। ফলে ফলন কম হলে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে ঘরের খাবার, সন্তানদের পড়াশোনা, এমনকি ঋণ পরিশোধের সামর্থ্যওে।
স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক জানান, ‘চাষে লোকসান হলে অনেক ছাত্র স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। তারা কৃষিকাজে সাহায্য করতে মাঠে যায়। শিক্ষার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়।’ একই সঙ্গে দেখা যায়, কিছু কৃষক মৌসুম শেষে গরু-ছাগল বিক্রি করে দেনা পরিশোধ করেন। এনজিও বা মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া চড়া সুদের ঋণ চেপে বসে পরিবারে। রায়পুরের কৃষকেরা এখন খরায় পুড়ে যাওয়া মাঠের দিকে তাকিয়ে আছেন দুশ্চিন্তা নিয়ে। তারা চান শুধু ফসল নয়, তাদের জীবনের পরিশ্রমটুকু যেন মূল্য পায়। সয়াবিনের মতো সম্ভাবনাময় ফসল যদি কৃষকের কাছেই অমুল্য হয়ে থাকে, তাহলে সেই চাষ ধরে রাখা যাবে না। বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন প্রযুক্তি, ন্যায্যমূল্য এবং কৃষকের পাশে দাঁড়ানো। রায়পুরের সয়াবিন চাষিদের কণ্ঠে তাই একটি প্রশ্ন’ এই ফসল কি শুধু আমাদের শ্রমই নেবে, তার কোনো ন্যায্য দাম কি আমাদের মিলবে না?’