সারাদেশে গত ছয়মাসে ১৭ হাজার ৯৫৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ হাজার ৮২৬ জন আহত হয়েছেন এবং নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৭৭৮ জন। এটি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এমনটাই বলছে গবেষণা সংস্থা সেভ দ্য রোড। কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, সড়কে বাইক লেন না থাকা, বেপরোয়া রাইড শেয়ারিং, ৩৫০ সিসিসহ দ্রুতগতি সম্পন্ন মোটরসাইকেল লাইসেন্সবিহীনভাবে পরিচালনা এবং প্রায় আড়াই লাখ অনুমোদনবিহীন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিশৃঙ্খল চলাচল।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ের সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য তুলে ধরেছে সেভ দ্য রোড। গতকাল রাজধানীর বিজয় মিলনায়তনে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠ করেন সংস্থাটির মহাসচিব শান্তা ফারজানা।
লিখিত প্রতিবেদনে তিনি জানান, কেবল ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, সিএনজিসহ থ্রি হুইলার ধরনের যানবাহনে ৮ হাজার ৮১২টি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৮১৫ জন এবং নিহত হয়েছেন ৭৯৫ জন। সেই সঙ্গে ৩ হাজার ৭১৪ টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬২৩ জন আহত এবং ৬৭৩ জন নিহত হন। ৩ হাজার ৪০৪টি বাস দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৩১৮ জন আহত এবং ৮২৫ জন নিহত হয়েছেন এবং ২ হাজার ২৭টি ট্রাক-পিকআপ-লরি দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৭০ জন আহত এবং ৪৮৫ জন নিহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর মতো দেশের অন্যান্য সেতু বা সড়কে বাইক লেন না থাকা, সেভ দ্য রোড-এর নিয়মিত প্রতিবেদন-সচেতনতা ক্যাম্পেইনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির পরও বেপরোয়া রাইড শেয়ারিং, ৩৫০ সিসিসহ দ্রুতগতি সম্পন্ন মোটরসাইকেল লাইসেন্সবিহীনভাবে পরিচালনা এবং প্রায় আড়াই লাখ অনুমোদনবিহীন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিশৃঙ্খল চলাচলে অহরহ রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে দুর্ঘটনা বেড়েছে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সেভ দ্য রোড এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিকাশ রায়, প্রতিষ্ঠাতা মোমিন মেহেদী, মহাসচিব শান্তা ফারজানাসহ সংশ্লিষ্ট গবেষণা সেল সদস্যদের তত্ত্বাবধানে দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক নয়াদিগন্ত, দৈনিক দিনকাল, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক কালবেলাসহ ১৭ টি জাতীয় দৈনিক, বাংলাভিশন, আরটিভি, জিটিভি, যমুনা নিউজ, মাছরাঙ্গা, এটিএন বাংলাসহ ২০ টিভি-চ্যানেল, জাগো নিউজ, বাংলানিউজ, বিডিনিউজসহ ২২টি নিউজ পোর্টাল এবং স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী, সেভ দ্য রোড-এর স্বেচ্ছাসেবীদের দেওয়া তথ্যানুসারে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
সেভ দ্য রোড-এর মহাসচিব এসময় আরও বলেন, আকাশ-সড়ক- রেল ও নৌপথ দুর্ঘটনামুক্ত করার জন্য নিবেদিত দেশের একমাত্র সচেতনতামূলক, গবেষণা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেভ দ্য রোড মনে করে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছিল তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীর অবহেলা আর উসকানির পাশাপাশি বিআরটিএর তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে, সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। কারণ অতীতের সরকারগুলোর মতো এই সরকারও সড়কে ফিটনেসবিহীন বাস ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে কেবল সংশ্লিষ্ট সেক্টরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা দুর্নীতিবাজ আমলা ও শ্রমিক নেতাদের সীমাহীন দুর্নীতি-চাঁদাবাজি ও অপরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে। গত ৬ মাসে সড়কে চরম নৈরাজ্য-আইন না মানার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ায় ক্রমশ সড়কে দুর্ঘটনা যেমন বেড়েছে, তেমন আহত এবং নিহতের সংখ্যাও বাড়ছে। এমন অবস্থায় সেভ দ্য রোড-এর পক্ষ থেকে সরকারি সহায়তার মাধ্যমে সমাজ সচেতনতা, গবেষণা ও স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ডের গতি বাড়ানোর লক্ষ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি প্রত্যাশা করছি।
সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা মোমিন মেহেদী বলেন. সেভ দ্য রোড-এর দাবি অনুযায়ী প্রতি ৩ কিলোমিটারে পুলিশ বুথ বা ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন না করা ও হাইওয়ে পুলিশসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের পুলিশ-প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সড়কপথে ৬ মাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ১১৮ টি। এ সময়ের মধ্যে ডাকাতদের হামলায় আহত হয়েছেন ১০৪ জন। এছাড়াও নারী শ্লীলতাহানীর ঘটনা ঘটেছে ৬১৪ টি, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২ টি। যার অধিকাংশই থানা-পুলিশের শরণাপন্ন হননি বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও সেভ দ্য রোড-এর স্বেচ্ছাসেবীদের তথ্যে উঠে এসেছে। নৌপথে কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার সুযোগে অন্য বছরের তুলনায় ডাকাতি বেড়েছে। রেলপথে মহাখালীতে দুষ্কৃতিকারীদের ছোড়া ইট-পাটকেল ও ছিনতাইকারীদের হামলায় ৪১ জনসহ মোট ৫৩ জন আহত হয়েছেন। এছাড়াও ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত নৌপথে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬১৫টি। আহত ৪৫১ জন, নিহত হয়েছেন ১৪ জন। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত রেলপথে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫২৬টি। আহত হয়েছেন ১৮৪ জন, নিহত হয়েছেন ১৪ জন।
উল্লিখিত সময়ের মধ্যে আকাশপথে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেও বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনার কারণে অসুস্থ হয়েছেন ৩১৬ জন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও সেভ দ্য রোড-এর স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে এই তথ্য সংগৃহীত হয়েছে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। এ সময় সেভ দ্য রোড-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, আকাশ, সড়ক, রেল ও নৌপথ দুর্ঘটনামুক্ত করার লক্ষ্যে গত ১৭ বছর ধরে রাজপথে থাকা স্বেচ্ছাসেবী, গবেষণা ও সচেতনতামূলক সংগঠন সেভ দ্য রোড মনে করে- সড়কপথ, নৌপথ ও রেলপথের দুর্ঘটনামুক্ত পথে চলাচলের অধিকার রক্ষায় মালিক-শ্রমিক-প্রশাসনিক এবং সাধারণ জনগণের সমন্বয়ের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি সেভ দ্য রোড সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত করতে ৭ দফা দাবি নিয়ে কাজ করছে।
তাদের ৭ দফা দাবি হলো-
১. মিরেরসরাই ট্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মরণে ১১ জুলাইকে ‘দুর্ঘটনামুক্ত পথ দিবস’ ঘোষণা করতে হবে।
২. ফুটপাত দখলমুক্ত করে যাত্রীদের চলাচলের সুবিধা দিতে হবে।
৩. সড়ক পথে ধর্ষণ-হয়রানি রোধে ফিটনেসবিহীন বাহন নিষিদ্ধ এবং কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ ও জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যতীত চালক-সহযোগী নিয়োগ ও হেলপার দ্বারা পরিবহন চালানো বন্ধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. স্থল-নৌ-রেল ও আকাশপথে দুর্ঘটনায় নিহতদের কমপক্ষে ১০ লাখ ও আহতদের ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ সরকারিভাবে দিতে হবে।
৫. ‘ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স রুল’ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সত্যিকারের সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ‘ট্রান্সপোর্ট পুলিশ ব্যাটালিয়ন’ গঠন করতে হবে।
৬. সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত ও সাজা ত্বরান্বিতকরণের মধ্য দিয়ে সতর্কতা তৈরি করতে হবে এবং ট্রান্সপোর্ট পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠনের আগ পর্যন্ত হাইওয়ে পুলিশ, নৌ-পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতাণ্ডসহমর্মিতাণ্ডসচেতনতার পাশাপাশি সব সড়কের চালক-শ্রমিক ও যাত্রীদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সব পরিবহন চালকের লাইসেন্স থাকতে হবে।
৭. ইউলুপ বৃদ্ধি, পথ-সেতুসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যাতে ভাঙা সড়ক, ভাঙা সেতু আর ভাঙা কালভার্টের কারণে আর কোনো প্রাণ দিতে না হয়।