
টাকা ছাপানো, সংরক্ষণ, সারা দেশে পরিবহন ও বণ্টনে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয় বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের এ বিপুল খরচ বাঁচাতে হলে নগদ অর্থ ব্যবহারের প্রবণতা কমিয়ে আনতে হবে। ক্যাশলেস বা নগদ অর্থ ছাড়াই লেনদেন বাড়াতে হবে। গতকাল রোববার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৩৬৫ দিন’শীর্ষক সংলাপে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এ কথা বলেন। এ সংলাপ আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
সংলাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, প্রতিবছর টাকা ছাপানো, পরিবহন ও বণ্টনে বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ হয়। এ খরচ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে কিউআর কোডভিত্তিক লেনদেন জনপ্রিয় করতে নীতিগত সহায়তা ও প্রযুক্তি অবকাঠামো তৈরির কাজ করছে।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কিউআর কোড ব্যবহার করতে হবে। এর ফলে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভোক্তা সবার জন্য লেনদেন হবে দ্রুত, নিরাপদ ও স্বচ্ছ। ক্যাশের ব্যবহার কমলে রাষ্ট্রীয় খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।
সংলাপে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য স্মার্টফোনের গুরুত্ব তুলে ধরেন আহসান এইচ মনসুর। বর্তমানে আর্থিক লেনদেন, বিল পরিশোধ বা ইন্টারনেটভিত্তিক যেকোনো সেবা নিতে স্মার্টফোনের ব্যবহার অপরিহার্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা স্মার্টফোনের দাম কমাতে কাজ করছেন। ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যে ভালো মানের স্মার্টফোন বাজারে আনতে পারলে শতভাগ মানুষকে স্মার্টফোনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। গভর্নর আরও বলেন, এ লক্ষ্য অর্জনে ইন্টারনেটের দাম আরও কমাতে হবে এবং সেবার মান বাড়াতে হবে। আলোচনায় নগরায়ণ ও আবাসন খাতের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে এখনো কয়েক মিলিয়ন নতুন আবাসনের প্রয়োজন রয়েছে। নগরকেন্দ্রিক উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী। কেননা, মানুষ গ্রামে ফেরত যাবে না। তাই সাশ্রয়ী আবাসন পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে। ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা জমি ডেভেলপারদের সঙ্গে অংশীদারত্বে ব্যবহারের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এলসি পরিস্থিতি স্বাভাবিক: গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের জন্য লাইন অব ক্রেডিট (এলসি) বন্ধ করেনি, বরং আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে। কেউ কেউ আগের চেয়ে এলসি সীমাও বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকারদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে ২০০-এর বেশি বিদেশি ব্যাংক এলসি বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন আমরা অনুরোধ করি, এখানেই থামুন, আর বন্ধ করবেন না। যদি উন্নতি করতে না পারি, তখন ব্যবস্থা নেবেন। আমরা কখনও বকেয়া রাখিনি, রাখবোও না। ২.৫ বিলিয়ন ডলারের বকেয়া ধীরে ধীরে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। রেমিট্যান্স ও রফতানি বাড়ার ফলে এখন সব বিদেশি ব্যাংক আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।’
ডলার বাজারে কঠোর নীতি: ড. আহসান জানান, গত বছরের ১৪ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এক ডলারও বিক্রি করেনি। ‘আমরা বুঝেছিলাম, মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম—ডলার বিক্রি করবো না। দুবাইভিত্তিক এগ্রিগেটরদেরও জানিয়ে দিয়েছি, আমাদের নির্ধারিত ১২২ টাকার রেটে বিক্রি করতে হবে, না হলে তাদের কাছ থেকে ডলার কেনা হবে না। তারা চাইলে ডলার ধরে রাখতে পারে, কিন্তু আমরা জানতাম, পাঁচ থেকে সাত দিনের বেশি তারা রাখতে পারবে না,’ বলেন তিনি।
অর্থনীতি ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে সতর্কতা: গভর্নর বলেন, ‘আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা এসেছে, তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখনও আসেনি। নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। নির্বাচনের আগে বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়া ঠিক হবে না। নির্বাচিত সরকার এসে কী পরিবর্তন আনে, তা বিনিয়োগকারীরা লক্ষ্য করবে।’ তিনি জানান, বাজারে তরল অর্থের প্রবাহ বাড়ছে এবং শেয়ারবাজার আগামী এক বছরে আরও এক হাজার পয়েন্ট বাড়তে পারে। এ বছর বৈদেশিক লেনদেনে উদ্বৃত্ত হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি ও রাজস্ব সংস্কার: ড. আহসান বলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তবে আরও কমানো দরকার। প্রতি মাসে কমবে না, তবে অর্থবছরের শেষে তা পাঁচ শতাংশের নিচে নামতে পারে।’ পাশাপাশি তিনি রাজস্ব আহরণ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
ব্যাংকিং খাতের সংস্কার: গভর্নর জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ সংশোধন করে পরিচালকদের মেয়াদ ৬ বছরে সীমাবদ্ধ করা হবে এবং বোর্ডে অন্তত ৬ জন স্বাধীন পরিচালক থাকতে হবে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২-এ মৌলিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নতুন ডিপোজিট ইন্সুরেন্স আইন প্রণয়ন এবং ব্যাংক রেগুলেশন অধ্যাদেশে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও ক্ষমতাবান করার উদ্যোগ চলছে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা কাঠামো এক করা হবে। যেকোনও ব্যাংক নন-পারফর্মিং হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, অদক্ষ ব্যাংককে জায়গা দেওয়া হবে না।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আইনের প্রয়োগে স্বাধীন ও শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন, এবং আর্থিক খাতকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।’
সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সংলাপে আরও উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রমুখ।