ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মায়ের দুধ কুদরতের অপূর্ব কারিশমা

নূর মুহাম্মদ রাহমানী
মায়ের দুধ কুদরতের অপূর্ব কারিশমা

বাচ্চাদের সুন্দর মতো লালন-পালন করা, তারবিয়াত শিক্ষা দেওয়া সদকায়ে জারিয়া। জাগতিক ও ধর্মীয় উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভালো ফলাফলের মাধ্যম। বাচ্চাকে দুধ পান করানো এবং তার লালন-পালন ইসলামি শিক্ষার অংশ। একজন মায়ের স্বভাবজাত দাবি এটি। তার নৈতিক দায়িত্বও বটে। বিশেষ কোনো অসুবিধা ছাড়া দুধ পান না করালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। অবশ্য দুনিয়ায় কেউ তাকে বাধ্য করতে পারবে না। বাচ্চাকে দুধ পান করানোর গুরুত্বহেতু অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আল্লাহতায়ালা নবী মুসা (আ.) এর মাকে নির্দেশ দিলেন তাকে দুধ পান করাতে। এরশাদ হয়েছে, ‘আমি মুসা-জননীকে আদেশ পাঠালাম যে, তাকে স্তন্য দান করতে থাক। অতঃপর যখন তুমি তার সম্পর্কে বিপদের আশঙ্কা কর, তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ কর এবং ভয় করো না, দুঃখও করো না। আমি অবশ্যই তাকে পয়গাম্বরদের একজন করব।’ (সুরা কাসাস : ০৭)।

বাচ্চাকে দুধ পান করানো, লালন-পালন করা এসব বিষয়ে শরিয়ত নারীর জন্য পুণ্যের ঘোষণা করেছে। স্ত্রী হওয়ার বিবেচনায় স্বামীর সন্তানদের প্রতি দয়ার্দ্র আচরণ করা, উত্তমভাবে লালন-পালন করার ব্যাপারে হাদিসে অনেক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘বাচ্চা জন্মগ্রহণ করার পর দুধের যে ফোঁটা বের হয় আর বাচ্চা যখন তা পান করতে থাকে তখন প্রত্যেক ঢোক এবং প্রত্যেক ফোঁটায় নারী নেকি পেতে থাকে।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ৪/৩৫২)।

আল্লাহতায়ালার অনেক বড় দয়া যে, তিনি সৃষ্টির আগেই মাখলুকের খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। একজন মা দুধ পান করিয়ে তার তৃষ্ণার্ত বাচ্চাকে যেমন তৃপ্ত করতে পারেন, তেমন মহান আল্লাহর কাছে উত্তম প্রতিদানেরও উপযুক্ত হতে পারেন। নবজাতককে দুধ পান করানো মহান আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দনীয় আমল। মায়ের জন্য এটি গর্বেরও বিষয়।

ইসলাম নবজাতককে দুধ পান করানোর প্রতি উৎসাহিত করেছে। দুধ পান করানোর বিধান বর্ণনা করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর সন্তানবতী নারীরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ ২ বছর দুধ খাওয়াবে যদি দুধ খাওয়ার পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করতে চায়। আর সন্তানের অধিকারী অর্থাৎ পিতার ওপর হলো সে সব নারীর খোরপোষের দায়িত্ব, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী। কাউকে তার সামর্থ্যরে অতিরিক্ত চাপের সম্মুখীন করা হয় না। আর মাকে তার সন্তানের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না এবং যার সন্তান তাকেও তার সন্তানের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন করা যাবে না। আর ওয়ারিশদের ওপরও দায়িত্ব এই। তারপর যদি পিতা-মাতা ইচ্ছা করে, তাহলে ২ বছরের ভেতরেই নিজেদের পারস্পরিক পরামর্শক্রমে দুধ ছাড়িয়ে দিতে পারে, তাতে তাদের কোনো পাপ নেই, আর যদি তোমরা কোনো ধাত্রীর দ্বারা নিজের সন্তানদের দুধ খাওয়াতে চাও, তাহলে যদি তোমরা সাব্যস্তকৃত প্রচলিত বিনিময় দিয়ে দাও তাতেও কোনো পাপ নেই। আর আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রেখো যে, আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ অত্যন্ত ভালো করেই দেখেন।’ (সুরা বাকারা : ১৩৩)।

দুধ পান করানোর সময় : বাচ্চাদের দুধ পান করানোর সর্বোচ্চ সময় ২ বছর। সুরা বাকারার উপরোক্ত আয়াতটি দ্বারাও তাই বোঝা যায়। সুরা আহকাফের ১৫ নম্বর আয়াতে এসেছে, ‘তাকে (গর্ভে) ধারণ ও দুধ ছাড়ানোর মেয়াদ হয় ৩০ মাস।’ মানব শিশুর জীবিত জন্মগ্রহণের সর্বনিম্ন মেয়াদ হলো ৬ মাস আর দুধ পান করানোর সর্বোচ্চ মেয়াদ ২ বছর। এ হিসেব ২ বছর বা ২৪ মাস দুধপানের সময় হয়।

তবে কোনো বাচ্চা যদি অতিশয় দুর্বল হয়, তাহলে তাকে প্রয়োজনবশত আড়াই বছর পর্যন্ত দুধ পান করানোর সুযোগ আছে। (ফাতাওয়া শামি : ৩/২০৯)। আড়াই বছর পরও যদি বাচ্চার বুকের দুধ পানের বিশেষ প্রয়োজন হয়, তাহলে একান্ত অপারগতাবশত অনেক গবেষক আলেমের মতে, খাদ্য হিসেবে দুধ পান করানো যায়।

অভিভাবকদের কর্তব্য : স্বামী ও অভিভাবকদের উচিত, এ সময়ে নবজাতক মাকে খুব বেশি সঙ্গ দেওয়া। সংশয়-ভীতি দূর করা। দুধ পান করানোর সঠিক পদ্ধতি জানিয়ে দেওয়া এবং সুষম খাবার-দাবারের ব্যাপারে তাকে সচেতন করা। গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে বাচ্চা প্রসব হওয়া পর্যন্ত প্রসূতি মায়ের যতœ নেওয়া পরিবারের লোকদের একান্ত কর্তব্য। তবে নিজের সচেতনতাই সবচেয়ে বড়। এ সময় মাকে স্বাস্থ্যের প্রতি যতœশীল হতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। কারণ, মায়ের প্রভাব শিশুর ওপর পড়ে।

মায়ের দুধ পান করানোর উপকারিতা : মায়ের কোনো উত্তম বিকল্প নেই, ঠিক তেমনি মায়ের দুধেরও কোনো বিকল্প নেই। মায়ের দুধ শিশুর জন্য উত্তম খাদ্য। এতে রয়েছে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ ও উপাদানসমৃদ্ধ এমন খাবার, যা শিশু সহজেই হজম করতে পারে। এটি কুদরতের অপূর্ব উপহার। অফুরন্ত নেয়ামত। নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও আদর্শ খাবার। মেডিকেল সায়েন্সও একথা স্বীকার করে। মানুষের ব্রেনের যে অংশে খুশি-আনন্দ ও চিন্তা-পেরেশানির অবস্থা সৃষ্টি হয় এর কাছাকাছি অবস্থান করে মায়ের দুধের কেন্দ্রস্থল। দুধের এই প্রভাব বাচ্চার ওপর পড়ে।

অনেকে মা বুকে নেমে আসা প্রথম শালদুধ খাওয়াতে চান না এটি একটি কুসংস্কার। শালদুধ শিশুর জন্য প্রাকৃতিক টিকা। অনেক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ।

মায়ের দুধ শিশুর জন্মগত অধিকার। মায়ের দুধ শুধু নবজাতকের ক্ষুধা ও পিপাসাই মিটায় না; বরং বাচ্চার সঙ্গে দৃঢ় বন্ধন তৈরি করে। মায়ের দুধ পানকারী বাচ্চা জ্ঞানী-মেধাবী হয়ে থাকে। অনেক রোগব্যাধি থেকে নিরাপদে থাকে। নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এতে কোনো ধরনের ইনফেকশন দ্বারা বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। মায়ের দুধ সুস্থ, দুর্বল অসুস্থ সব ধরনের বাচ্চার জন্য উপকারী। এটা পান করলে বাচ্চা সুস্বাস্থ্যবান হয়। অতিরিক্তি মোটা হয় না।

বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করালে শুধু যে বাচ্চার উপকার তা নয়; বরং নবজাতক মায়েরও রয়েছে বহুবিধ উপকার। সন্তানকে দুধ খাওয়ালে মা নিজেও উপকৃত হন। প্রসবজনিত রক্তপাত দ্রুত বন্ধ হয়। পরে রক্তস্বল্পতা হয় না। গর্ভজনিত স্ফীত জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। যেসব মা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ান তাদের স্তন, জরায়ু এবং ডিম্বকোষের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। বুকের দুধ খাওয়ালে স্বাভাবিক জন্মনিয়ন্ত্রণে তা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া যারা ঘন ঘন গর্ভবতী হতে চান না, তাদের জন্যও তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। মা ও শিশুর আত্মিক বন্ধন দৃঢ় হয়।

বিশেষ অবস্থায় বাচ্চাকে দুধ পান করানো : সহবাসের পর কিংবা অন্য কোনো কারণে গোসল ফরজ হওয়ার পর গোসল না করে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো জায়েজ। এতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ মোমিন নাপাক হয় না। মোমিনের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই পবিত্র। অবশ্য গোসল ফরজ হওয়ার পর দুধ খাওয়ানো কিংবা যে কোনো কাজ করার আগে অজু করে নেওয়া উত্তম। আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, ‘একদিন তিনি জুনুবি (নাপাক) অবস্থায় ছিলেন। এ অবস্থায় মদিনার এক রাস্তায় নবী (সা.) এর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তখন তিনি চুপিসারে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেন এবং গোসল করলেন। নবী (সা.) তাকে তালাশ করে পেলেন না। পরে যখন তিনি এলেন, তখন নবী (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু হুরাইরা এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে? আবু হুরাইরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার সঙ্গে আমার যখন সাক্ষাৎ হলো তখন আমার ওপর গোসল ফরজ ছিল। এ অবস্থায় আমি গোসল না করা পর্যন্ত আপনার সান্নিধ্যে আসা বা আপনার সঙ্গে মেলামেশা করা পছন্দ করিনি। একথা শুনে রাসুল (সা.) বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, সুবহানাল্লাহ! (কি বলছ?) ‘মোমিন অপবিত্র হয় না।’ (মুসলিম : ৩৭১)।

লেখক : শিক্ষক, হাদিস ও ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত