প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
আল্লাহতায়ালা সৃষ্টির প্রতি পরম দয়ালু ও বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত করুণাময়। তাঁর রহমতের দিকগুলো গোনা যায় না এবং মানুষের বুদ্ধি দিয়ে তার পূর্ণতা ধারণ করা সম্ভব হয় না। তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমত শুরু করেন, তখন থেকেই যখন তারা ছিল শুধু একটি বীর্যবিন্দু। মায়ের গর্ভে তাদের সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটান, তারপর মায়ের গর্ভ থেকে তাদের বের করে আনেন। এরপর পৃথিবীতে তিনি তাদের অগণিত নেয়ামত দান করেন, বিভিন্ন কল্যাণের পথে পরিচালিত করেন- যা মানুষকে শান্তির ঘর জান্নাতে পৌঁছে দেয়। তিনি দেখিয়ে দেন সেই সব পথ, যা মানুষকে এই দুনিয়ায় সঠিক পথে স্থির রাখে, যাতে তারা পথভ্রষ্ট না হয়; আর আখেরাতে তাদের পা যেন জাহান্নামের দিকে পিছলে না যায়।
মানুষের উত্তম চরিত্র ও ইসলামের মহান গুণগুলোর একটি হলো ধৈর্য। এর প্রতি মহান আল্লাহ আহ্বান করেছেন এবং এর দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেকে সুসজ্জিত করেছেন। এই ধৈর্য সংকল্পবানদের বৈশিষ্ট্য ও দৃঢ়চিত্ত লোকদের পোশাকস্বরূপ। ধৈর্য হচ্ছে প্রতিটি ইবাদতের মূল ও প্রতিটি কল্যাণের বীজ- যা এই দুনিয়া ও আখেরাতে মানুষকে উপকৃত করে। সফলতা ধৈর্যের সঙ্গে জড়িত; জান্নাত লাভ ধৈর্যের ওপর নির্ভরশীল; আর জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতেও ধৈর্যের গুণ অর্জন করা জরুরি। ধৈর্যের ফল শুভ ও ধৈর্যশীলরা ভাগ্যবান।
আল্লাহর হিকমত ও তাঁর নিয়ম এমনই যে, ধৈর্য ছাড়া কোনো বড় কল্যাণ পাওয়া যায় না। মানুষও প্রকৃতিগতভাবে জানে যে, কোনো ভালোকিছু পেতে হলে কষ্ট সহ্য করতে হয়। নিজের রিজিক অর্জন বা ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য তার পরিশ্রমই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কোরআন প্রায় ১০০ জায়গায় শিক্ষা দিয়েছে যে, ধৈর্য আল্লাহর আদেশ, আর ধৈর্য ধারণের শক্তি আল্লাহ থেকেই আসে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি ধৈর্য ধারণ কর, তোমার ধৈর্য তো আল্লাহরই সাহায্যে। এদের দরুন দুঃখ করো না এবং এদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ো না।’ (সুরা নাহল : ১২৭)। যে বান্দা তাঁর প্রভুর নির্দেশ মেনে চলে, সে সফলতা পায়। চাইলে তার লক্ষ্য পূরণ হয় ও ভয় থেকে মুক্তি মেলে। আল্লাহ বলেছেন, ধৈর্যশীলদের সঙ্গে তিনি আছেন; তাদের সাহায্য করেন, রক্ষা করেন ও তত্ত্বাবধান করেন।
কোরআনে আছে, ‘তোমরা ধৈর্য ধারণ কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনফাল : ৪৬)। ধৈর্যশীলরাই জান্নাতের প্রকৃত বিজয়ী মর্মে আল্লাহতাালা বলেন, ‘আমি আজ তাদেরকে তাদের ধৈর্যের কারণে এমনভাবে পুরস্কৃত করলাম যে, তারাই হল সফলকাম।’ (সুরা মোমিনুন : ১১১)। আর যখন তারা কোনো বিপদে ধৈর্য ধরে, তখন আল্লাহ তাদের প্রতি বিশেষ দোয়া, রহমত ও হিদায়াত নাজিল করেন; তাদের জন্য রয়েছে সীমাহীন প্রতিদান, যার কোনো হিসাব নেই। আল্লাহ বলেন, ‘ধৈর্যশীলদের তো অপরিমিত পুরস্কার দেওয়া হবে।’ (সুরা জুমার : ১০)। আবদুল্লাহ ইবন আউন (রহ.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক কাজের জন্য নির্দিষ্ট প্রতিদান আছে, কিন্তু ধৈর্যের প্রতিদান সীমাহীন।’
আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আর তাদের ধৈর্যশীলতার পুরস্কারস্বরূপ তাদের দেবেন উদ্যান ও রেশমী বস্ত্র।’ (সুরা দাহর : ১২)। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘ধৈর্যের মধ্যে যেহেতু কষ্ট আছে ও নিজের নফসকে চাওয়া-পাওয়া থেকে বিরত রাখা আছে, তাই তাদের প্রতিদানে আল্লাহ জান্নাতের প্রশস্ততা ও রেশমের কোমলতা রেখেছেন, যা সেই কষ্ট ও বঞ্চনার বিপরীতে পুরস্কার স্বরূপ।’
আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কোনো কষ্টে মুমিন যে ধৈর্য ধরে, তার বিনিময় হলো কল্যাণ ও জান্নাত। তিনি বলেছেন, ‘মুমিনের ব্যাপার সত্যিই বিস্ময়কর! তার সবকিছুই তার জন্য কল্যাণ। সুখ এলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তা তার জন্য ভালো। আর দুঃখ-দুর্দশা এলে ধৈর্য ধারণ করে, এটাও তার জন্য ভালো।’ (মুসলিম : ৭৩৯০)। নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি যদি আমার বান্দার দুটি প্রিয় চোখ কেড়ে নিই, আর সে যদি ধৈর্য ধারণ করে, তাহলে আমি তাকে এর বদলে জান্নাত দেব।’ (বোখারি : ৫৬৫৩)।
দুনিয়া হলো পরীক্ষা ও বিপদের ঘর। এখানে যে আসবে, তাকে অবশ্যই কিছু না কিছু কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে। আর এসব বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র দুর্গ হলো ধৈয- যেখানে আশ্রয় নিলে মানুষ সফলতা ও মুক্তি পায়। ধৈর্যশীল মানুষ সেই কঠিন দিনের প্রতিদানের কথা মনে করে নিজেকে সান্ত¡না দেয় যেদিন আল্লাহ ধৈর্যশীলদের পূর্ণ পুরস্কার দেবেন। ধৈর্যশীল লোকরা আল্লাহর দেওয়া এক শক্তির অধিকারী। এই শক্তি তাকে নিজের নফস দমন করতে, নিজের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ও ভুল পথে যেতে বাধা দেয়। এই শক্তি যার আছে নফস তাকে আর সহজে বন্দি করতে বা ক্ষতির দিকে ঠেলে দিতে পারে না। ধৈর্যের শক্তি অর্জন করা যায় কেবল দৃঢ় সংকল্প ও স্থিরতার মাধ্যমে। যে ধৈর্য ধারণ করে, ধৈর্যই তাকে পথ দেখায় ও তার প্রভুর দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ধৈর্য হলো আলো।’ আলো পথ দেখায়, কিন্তু এর সঙ্গে কিছু উত্তাপও থাকে। ধৈর্যও ঠিক তেমন। এতে কষ্ট আছে, কারণ এতে নফসকে চেনা-পরিচিত আরাম ও ইচ্ছা থেকে বিরত রাখতে হয়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। ধৈর্য মুমিনের জন্য অপরিহার্য। যতদিন আল্লাহর বিধানভুক্ত থাকবে, ততদিন তার ধৈর্য লাগবে। ঈমান দুইভাগে বিভক্ত। অর্ধেক হলো শুকর ও অর্ধেক হলো সবর। এ কথা হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বলেছেন, যিনি চরিত্রে ও আচরণে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মতো ছিলেন। ধর্মের দলিল-প্রমাণও দেখায় যে, শুকর সম্পূর্ণ হয় না ধৈর্য ছাড়া। কারণ তাকওয়া, আল্লাহর আনুগত্য, সত্য অনুসরণ- এসবই শুকরের আসল রূপ। আর এগুলো করতে হলে ধৈর্যের প্রয়োজন। এ কারণে কোরআনের চার জায়গায় শুকর ও সবরকে একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহর ইবাদত, তাঁর ফরজ, নফল, সুন্নাহ ও আদব সম্পন্ন করা এবং পাপ থেকে দূরে থাকা ধৈর্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ জন্যই আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও তাদের অন্তর্র্বর্তী যা কিছু, তার প্রতিপালক। সুতরাং তাঁরই ইবাদত কর এবং তাঁর ইবাদতে ধৈর্যশীল থাক।’ (সুরা মরিয়ম : ৬৫)। ধৈর্যশীলদের নেতা আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাত ঘেরা রয়েছে অপছন্দনীয় জিনিসে, আর জাহান্নাম ঘেরা রয়েছে কামনা-বাসনায়।’ (তিরমিজি : ২৫৫৯)।
আল্লাহর স্থির করা নিয়ম হলো, জান্নাতের পথ এমন সব পরীক্ষায় ভরা থাকে, যা মানুষ স্বাভাবিকভাবে অপছন্দ করে। ধন-সম্পদ বা দারিদ্র্যের পরীক্ষা, সুখ-দুঃখের পরীক্ষা, আল্লাহর বিধান পালন, রোগ-ব্যাধি, ক্ষতি, দুঃখ, ঋণ ও চিন্তা মানুষের কোনো ক্ষমতা ছাড়াই ঘটে যায়। জান্নাতে প্রবেশ ধৈর্য ছাড়া সম্ভব নয়। কষ্টের পথ মাড়িয়েই জান্নাতে যেতে হয়। আর জাহান্নামের পথ ভরা থাকে নফসের কামনা ও শয়তানের প্রলোভনে। মানুষ সাধারণত সেই পথেই বেশি দ্রুত অগ্রসর হয়, কারণ সেখানে আরাম, আনন্দ ও ইচ্ছাপূরণ আছে।
মহান আল্লাহ পরম দয়ালু, অতীব কোমল ও তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে সবকিছু জানেন। তিনিই তাদের ধৈর্য দান করেছেন। আর যখন মানুষ এই ধৈর্যকে তাদের দ্বীন ও আল্লাহর পথে চলার ভিত্তি বানায় তখন তারা নিজেদের নফসকে পরাজিত করতে পারে; সেই নফস, যা সবসময় আরামের দিকে ঝোঁকে, আলস্যকে ভালোবাসে, খারাপকে ভালো মনে করে এবং ভালোর চেয়ে মন্দকে পছন্দ করে। ধৈর্যের সাহায্যে তারা শত্রুকেও জয় করতে পারে। কারণ আল্লাহ ধৈর্য ও তাকওয়াকে বানিয়েছেন শক্তিশালী ঢাল, যার আড়ালে বান্দারা শত্রুর ধোঁকা ও ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যদি ধৈর্যশীল ও মুত্তাকী হও তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১২০)। আল্লাহ ধৈর্যকে মুসলমানদের জন্য এমন একটি অস্ত্র বানিয়েছেন যার মাধ্যমে তারা শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে। শয়তান মানুষকে সত্য থেকে ফিরিয়ে রাখে, মিথ্যা সুন্দর করে দেখায়, পাপে প্রলুব্ধ করে, খারাপ কাজকে সহজ মনে করায়, দারিদ্র্যের ভয় দেখায় ও অশ্লীলতার দিকে ঠেলে দেয়। ধৈর্যশীলরা আল্লাহর হক আদায়ে ধৈর্য ধরে, নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে, আল্লাহর সীমারেখায় থেমে যায়, হারাম থেকে নিজেকে দূরে রাখে এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয় না, কারণ তারা বিশ্বাস করে, যিনি এসব নির্ধারণ করেন তিনিই সবকিছুর মালিক ও স্রষ্টা। তারা ধৈর্য ধরে আল্লাহর কাছ থেকে বিশাল প্রতিদান পাওয়ার আশায়, আল্লাহকে ভয় করে, তাঁর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়ে আল্লাহকে ভালোবেসে। ফলে আল্লাহ তাদের ধৈর্যের বিনিময় দেন- পাপ মোচন, মর্যাদা বৃদ্ধি ও অসংখ্য পুরস্কার।
যাকে আল্লাহ ধৈর্য দিয়েছেন, তাকে সত্যিই বিরাট কল্যাণ দান করেছেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে নিজের ইজ্জত রক্ষা করে আল্লাহ তাকে সম্মান দেন; যে আল্লাহর কাছে সমৃদ্ধি চায় আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী করেন; যে ধৈর্য ধারণ করতে চায় আল্লাহ তাকে ধৈর্য দেন। আর কাউকে ধৈর্যের চেয়ে ভালো ও বেশি কোনো দান দেওয়া হয়নি।’ (বোখারি : ১৪৬৯)। নবী করিম (সা.)-এর বাণী কী চমৎকার! যারা চিন্তা করে তাদের জন্য এতে কত বরকত নিহিত! এখানে বিশ্বনবী (সা.) আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, ধৈর্য হলো আল্লাহর দান, যেন মানুষ ধৈর্যের মূল্য বুঝতে পারে, ধৈর্যের ফলকে মিষ্ট অনুভব করতে পারে ও তার মাধ্যমে আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্ট হয়। আল্লাহ ধৈর্য দেন সেই ব্যক্তিকে যে ধৈর্যকে বেছে নেয়, তা অর্জনে চেষ্টা করে, এর ফল সম্পর্কে ভাবে ও তার শুভ পরিণতি কামনা করে।
যেসব লোক ইবাদতে ধৈর্য ধরে, হারাম থেকে দূরে থাকতে ধৈর্য ধরে, বিপদ ও কষ্টে ধৈর্য ধরে- তাদের পুরস্কার হলো জান্নাত, যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের মতো। সেই জান্নাতের জন্য ধৈর্যশীলরা কঠোর চেষ্টা করে, কারণ তারা জানে, দুনিয়া হলো পরীক্ষা সহ্য করার স্থান, আরাম ও স্থায়ী শান্তির জায়গা নয়। এজন্যই ফেরেশতারা তাদের বলবে, ‘তোমরা ধৈর্যধারণ করেছ বলে তোমাদের প্রতি শান্তি; কত উত্তম এই পরিণাম।’ (সুরা রাদ : ২৪)।
হে আল্লাহ! হে দয়ালু, হে অফুরন্ত অনুগ্রহের মালিক! আমাদের দাও তোমার ইবাদতে ধৈর্য, পাপ থেকে দূরে থাকতে ধৈর্য, তোমার পছন্দসই কাজে ধৈর্য, যা আমাদের অপছন্দ, তাতেও ধৈর্য এবং বড় বড় সিদ্ধান্তের সময় ধৈর্য। সেইসঙ্গে তুমি আমাদের ক্ষমা ও সুস্থতা প্রদান কর।
(০৭-০৬-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ২৮-১১-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস- আবদুল কাইয়ুম শেখ)