প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের অদূরে অবস্থিত ঐতিহাসিক নগরী হিমস। এর নাগরিকদের অভিযোগের যেন অন্ত নেই। যেই গভর্নরই আসেন তার বিরুদ্ধেই খলিফার দরবারে নালিশের পাহাড় জমে। এই পরিস্থিতিতে বিরক্ত হয়ে খলিফা হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এমন একজন ব্যক্তিকে খুঁজছিলেন যার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসবে না। অনেক ভেবে তিনি রাসুল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবি সাঈদ ইবনে আমের জুমহি (রা.)-কে এই গুরুদায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
সাঈদ ইবনে আমের জুমহি (রা.) প্রথমে এই দায়িত্ব নিতে রাজি ছিলেন না। তিনি খলিফাকে বিনীতভাবে অনুরোধ করলেন তাকে এই পরীক্ষায় না ফেলতে। কিন্তু খলিফা ছাড়লেন না। তিনি বললেন, আমার কাঁধে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে তোমরা দূরে থাকবে, তা হতে পারে না। শেষ পর্যন্ত খলিফার নির্দেশে হজরত সাঈদ ইবনে আমের জুমহি (রা.) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হিমসে যাত্রাকালে তিনি বাইতুল মাল থেকে কোনো ভাতা নিতে অস্বীকৃতি জানান।
গভর্নর হিসেবে যোগদানের পর এক বছর কেটে গেল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই দীর্ঘ সময়ে হিমস থেকে কোনো অভিযোগ এলো না। কিছুদিন পর হিমসবাসীদের এক প্রতিনিধি দল মদিনায় খলিফার সঙ্গে দেখা করতে এলো। খলিফা তাদের অঞ্চলের দরিদ্রদের তালিকা চাইলেন, যাতে বায়তুল মাল থেকে সাহায্য করা যায়। তালিকার এক নম্বরে গভর্নর সাঈদ ইবনে আমেরের নাম দেখে খলিফা চমকে উঠলেন। সত্যতা নিশ্চিত হয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং তৎক্ষণাৎ এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার একটি থলে গভর্নরের ব্যক্তিগত খরচের জন্য পাঠিয়ে দিলেন।
স্বর্ণমুদ্রার থলেটি হাতে পেয়ে সাঈদ ইবনে আমের জুমহি (রা.) ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করলেন। তার স্ত্রী বিচলিত হয়ে ভাবলেন, খলিফা হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন বা মদিনায় কোনো শত্রুবাহিনী আক্রমণ করেছে। সাঈদ ইবনে আমের জুমহি (রা.) জানালেন, তার আখেরাত ধ্বংস করার জন্য দুনিয়া তার ঘরে প্রবেশ করেছে। তিনি কালবিলম্ব না করে সেই স্বর্ণমুদ্রা গরিব-দুঃখী মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিলেন।
কিছুদিন পর খলিফা ওমর নিজেই হিমস পরিদর্শনে গেলেন। তিনি জনসমক্ষে গভর্নরের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে কি না জানতে চাইলেন। নগরবাসী গভর্নরের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ পেশ করলেন। প্রথমত, তিনি সকালে দেরি করে বের হন। দ্বিতীয়ত, রাতে তিনি কারও ডাকে সাড়া দেন না। তৃতীয়ত, সপ্তাহে একদিন তিনি জনসম্মুখে আসেন না। চতুর্থত, তিনি মাঝেমধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
খলিফা ওমর (রা.)-এর জিজ্ঞাসাবাদের মুখে সাঈদ ইবনে আমের জুমহি (রা.) অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এসবের জবাব দিলেন। সকালে বের হতে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানান, তার কোনো গৃহকর্মী নেই।
তাই আটা পেষা থেকে শুরু করে রুটি বানানো পর্যন্ত সব কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করতে গিয়ে সকালে বের হতে তার দেরি হয়ে যায়। রাতের বিষয়ে বলেন, তিনি দিনটা রেখেছেন মানুষের সেবার জন্য। আর রাতটা নির্দিষ্ট করেছেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইবাদতের জন্য। সপ্তাহে একদিন অনুপস্থিত থাকার কারণ হলো, তার মাত্র এক জোড়া পোশাক। তা ধুয়ে শুকানোর জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়, তাই সেদিন বের হতে পারেন না। জ্ঞান হারানোর বিষয়ে তিনি জানান, ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি খুবাইব ইবনে আদি (রা.)-এর শাহাদাতের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছিলেন। কাফেররা যখন খুবাইব (রা.)-এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলছিল তখনো তিনি রাসুল (সা.)-এর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার নজির স্থাপন করেছিলেন। কাফেররা তাকে বলেছিল, যদি তুমি মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করো তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেব। তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহর শপথ! মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার বিনিময়ে আমার মুক্তি পাওয়া তো দূরের কথা, পথে হেঁটে যেতে তার পায়ে একটি কাঁটার আঁচড় লাগুক সেটাও আমি সহ্য করতে পারব না। মুনাফেকি জীবন থেকে শহিদি মৃত্যু আমার কাছে অনেক উত্তম।’ সেই দিন খুবাইব (রা.)-কে সাহায্য করতে না পারার অনুশোচনা এবং আল্লাহর ভয়ে তিনি মাঝেমধ্যে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলে বেহুঁশ হয়ে যান।
এসব শুনে খলিফা ওমর (রা.) মুগ্ধ হলেন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। পোশাক নেই বা গৃহকর্মী নেই এবং অতিরিক্ত ভাতা পেলেও তা গরিবদের দিয়ে দেন এমন একজন শাসক ইতিহাসের পাতায় বিরল। তার এই নির্লোভ জীবনযাপন ও আত্মত্যাগ আমাদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।