প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
মানুষ সামাজিক জীব। সঙ্গ বা সান্নিধ্য ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আর সন্ন্যাসী জীবনযাপন ইসলাম অনুমোদন করে না। তাহলে কাকে সঙ্গী-সাথি বানাতে হবে? বা কার সান্নিধ্যে চলতে হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘মোমিনরা যেন অন্য মোমিনকে ছেড়ে কোনো কাফিরকে বন্ধুরূপে প্রহণ না করে। আর যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’ (সুরা আলে ইমরান : ২)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও।’ (সুরা তওবা : ১১৯)।
মানুষ একা চলতে পারে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিশতে হয়। চলতে হয়। কথা বলতে হয়। তবে এক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা হলো, পুণ্যবান ও সৎ মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। পুণ্যবানদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে হবে। বন্ধু নির্বাচনেও খুব সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ভালো বন্ধু জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে, মন্দ বন্ধু জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই মুসলিমদের এ ব্যাপারে সাবধান করতেন। সৎসঙ্গী নির্বাচনের তাগিদ দিতেন। কারণ, যাদের সঙ্গে মানুষ নিয়মিত ওঠাবসা করে, তাদের স্বভাব ও চরিত্র দ্রুত তার মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। কেননা, মেলামেশা, ওঠাবসা ও দীর্ঘ আলাপের কারণে মানুষ সঙ্গীদের চরিত্র ধারণ করে খুব সহজে। অনেক সময় তার মাঝে সেই চরিত্র প্রবেশ করতে থাকে খুব ধীর গতিতে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর ধর্ম অনুসরণ করে। কাজেই তোমাদের সতর্ক থাকা উচিত যে, তুমি কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছ।’ (আবু দাউদ : ৪৮৩৩)।
অসৎসঙ্গের কারণে মানুষের জীবনে যে পরিবর্তন ঘটে তা এক সময় ধর্ম পরিবর্তন পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এ জন্য সঙ্গলাভের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আবু মুসা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সৎসঙ্গী ও অসৎসঙ্গীর উদাহরণ আতর বিক্রেতা ও কর্মকারের হাপরের ন্যায়। আতর বিক্রেতার কাছে গেলে তুমি রেহাই পাবে না। হয় তুমি আতর কিনবে, না হয় আতরের সুঘ্রাণ পাবে। আর কর্মকারের কাছে গেলে তার হাপর হয় তোমার শরীর বা কাপড় পুড়িয়ে দেবে, না হয় তুমি তার দুর্গন্ধ পাবে।’ (বোখারি : ১৯৯৫)।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্যতম সুন্নাহ হলো, সৎ, পুণ্যবান ও মুমিনদের সংস্রব গ্রহণ করা। মুমিন ছাড়া কারও সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মেশা যাবে না। আল্লাহভীরু ছাড়া ভিন্ন কাউকে খাবারও খাওয়ানো যাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মোমিন ছাড়া আর কারও সংস্রবে যেয়ো না। আর তোমার খাবার যেন শুধু তাকওয়ার অধিকারী মোমিনরাই খায়।’ (আবু দাউদ : ৪৮৩২)।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীরা একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয়। মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠিত করে, জাকাত দেয়, আল্লাহ ও রসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করে। তাদের ওপর আল্লাহতায়ালা অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী সুকৌশলী।’ (সুরা তওবা : ৭১)।
অপরিচিতজনকে বন্ধু নির্বাচনে সতর্কতা সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের আপনজন ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে কোনো ত্রুটি করবে না। যা তোমাদের ক্ষতি করে তাই তাই তারা কামনা করে। তাদের মনের হিংসা ও বিদ্বেষ তাদের মুখ থেকে প্রকাশ পেয়ে গেছে এবং যা কিছু তারা নিজেদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে তা এর চেয়েও মারাত্মক। আমি তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি। যদি তোমরা অনুধাবন করো। তোমরা তাদের ভালোবাসো; কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালোবাসেনা অথচ তোমরা সমস্ত আসমানি কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। তারা তোমাদের সঙ্গে মিলিত হলে বলে, আমরাও বিশ্বাস করি। কিন্তু তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের ক্রোধ ও আক্রোশ এতো বেশি বেড়ে যায় যে, তারা নিজেদের আঙুল কামড়াতে থাকে। তাদের বলো, নিজেদের ক্রোধ ও আক্রোশে তোমরা নিজেরাই জ্বলে পুড়ে মরো। আল্লাহ মনের গোপন কথাও জানেন। তোমাদের ভালো হলে তাদের খারাপ লাগে এবং তোমাদের ওপর কোনো বিপদ এলে তারা খুশি হয়। তোমরা যদি সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা কিছু করছে আল্লাহ তা বেষ্টন করে আছেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১১৮-১২০)।
মুসলিমদের প্রতি কেউ যদি হিংসা-বিদ্বেষ গোপন রাখে, ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে, মুসলিমদের ক্ষতি করা পছন্দ করে, যে কোনো উপায়ে তারা মুসলিমদের কষ্ট দেওয়ার পরিকল্পনা যারা করে, তাদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন। যে, মুসলিমগণ অমুসলিমদের প্রতি যে আস্থা ও বিশ্বাস রাখে তারা তাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিমদের ক্ষতি করার পরিকল্পনা করে। তাদেরকে কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করে। এজন্য এ ধরণের মানুষকে বন্ধু বানানো যাবে না। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রা.) আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি ওমর (রা.)-কে বললাম, আমার একজন খ্রিষ্টান সেক্রেটারি রয়েছে। তিনি বললেন, তোমার কী হলো? আল্লাহ তোমার অকল্যাণ করুন! তুমি কি আল্লাহর এ কথা শোন নি? আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! ইয়াহুদি ও খ্রিষ্টানদের নিজেদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর যদি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে তাহলে সেও তাদের মধ্যেই গণ্য হবে। অবশ্যই আল্লাহ জালেমদের সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা মায়েদা : ৫১)
কোরআনের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মোমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’ (সুরা আলে ইমরান : ২৮)।
সত্যবাদী মানুষকে বন্ধু বানাতে হবে। যে কাউকে বন্ধু বলা যায় না, বন্ধু বানানো যায় না। সত্যবাদী, নামাজি, দ্বীনদার ও পরোপকারী ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করা উচিত। এ জন্য কোরআনে বন্ধু নির্বাচনের দিকনির্দেশনা প্রদান করে আল্লাহ বলেন, ‘আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে। আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে অবচেতন করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।’ (সুরা কাহাফ : ২৮)।
বন্ধু নির্বাচনে কেমন ব্যক্তি অগ্রাধিকার পাবে- এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে গিয়ে পবিত্র কোরআনে আরো সুস্পষ্ট ঘোষণা এসেছে। ‘হে মোমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।’ (সুরা তওবা : ১১৯)।
ইমাম গাজালি (রহ.) বলেছেন, যার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে তার মধ্যে পাঁচটি গুণ থাকা চাই। তা হলো, বুদ্ধিমত্তা ও সৎ স্বভাবের অধিকারী হওয়া এবং পাপাচারী, বেদআতি ও দুনিয়াসক্ত না হওয়া। হজরত ইমাম জাফর আস-সাদিক (রহ.) মুসলিম মিল্লাতকে বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক করে বলেছেন, পাঁচ ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সমীচীন নয়। তা হলো- মিথ্যাবাদী, নির্বোধ, ভীরু, পাপাচারী ও কৃপণ ব্যক্তি। বন্ধু মনোনয়নে হজরত আলী (রা.)-এর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, নির্বোধের বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাক। কারণ সে উপকার করতে চাইলেও তার দ্বারা তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে। (দিওয়ানে আলি)।
পরোপকারীকে বন্ধু বানাতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো বন্ধুর অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হলো বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া। এই বিবেকবান বন্ধু সদুপদেষ্টা হয়। তার ওপর সব সময় আস্থা রাখা যায় কেননা, এ ধরনের বন্ধু ভুলত্রুটি থেকে ফিরিয়ে রাখে। বিশেষ করে সে পরোপকারী হয়।
আলি (রা.) বলেছেন, ‘বিবেকবান বন্ধুর সাহচর্য অন্তরাত্মাকে প্রাণচাঞ্চল্য দান করে। পক্ষান্তরে অজ্ঞ এবং মূর্খ বন্ধু কারও কোনো উপকার তো করেই না বরং তার কথাবার্তা আর আচার-আচরণ অন্যদের বিরক্তি আর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বন্ধুত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার হচ্ছে অসুখ-বিসুখ, বিপদণ্ডআপদেও বন্ধুত্ব অটুট রাখা। লোকমান হাকিম বলেছেন, ‘প্রয়োজনের মুহূর্ত ছাড়া বন্ধুকে চেনা যায় না।’ একজন ভালো বন্ধু পাওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে কোনো ধরনের স্বার্থ কিংবা প্রাপ্তির চিন্তা মাথায় না রাখা। সে বন্ধু অবশ্যই পরোপকারীকে বন্ধু হবে।