আব্বাসি খলিফা আবু জাফর আল-মানসুর নিজ শাসনকালে বিখ্যাত মুহাদ্দিস শারিক বিন আবদুল্লাহকে (রহ.) কুফার বিচারপতি পদ গ্রহণের আবেদন করেন। শারিক (রহ.) নিজের পরিবর্তে ইমাম আবু হানিফাকে (রহ.) ওই পদে বসানোর মত দেন। খলিফা মানসুর ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এ পদ গ্রহণে অস্বীকৃতির ব্যাপারটি সহজে সহ্য করেননি। তবে শারিকের (রহ.) ওপর কঠোরতা আরোপের পরিবর্তে নম্রতার সঙ্গে বারবার আবেদন করেন, রাষ্ট্রের বিচারক পদে এমন লোকের প্রয়োজন, যিনি ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী প্রজাদের কাছে সঠিক বিচার দ্রুত পৌঁছে দেবেন।
খলিফা মানসুরের পীড়াপীড়িতে শারিক (রহ.) বিচারকের পদ গ্রহণ করেন। খলিফা মানসুরের মৃত্যুর পর পুত্র মাহদি খেলাফতের পদে আসীন হন। তিনি শারিকের (রহ.) পদ বহাল রাখেন।
একবার শারিকের (রহ.) আদালতে একজন মহিলা কুফার গভর্নর মুসা বিন ঈসার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, গভর্নর আমার খেজুর বাগান জোরপূর্বক ক্রয় করতে চেয়েছিল; কিন্তু আমি বিক্রি করিনি। আমি যেন বাগান বিক্রি করতে বাধ্য হই, এ জন্য গভর্নর আমার বাগানের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে দিয়েছে। আমি ন্যায়বিচার চাই। ওই মহিলা পিতার মিরাস থেকে ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত ওই বাগানের মালিকানা লাভ করেছিলেন।
অভিযোগ পেয়ে শারিক (রহ.) গভর্নর মুসাকে আদালতে তলব করেন। গভর্নর বার্তাবাহকের কাছে থেকে ফরমান পেয়েই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। রক্ষীকে বললেন, বিচারককে গিয়ে বল, তিনি যেন আমার পদের কথা স্মরণ রাখেন এবং একজন নগণ্য নারীর কথায় বিচারে দাঁড় না করান। রক্ষী গভর্নরের বার্তা শারিকের (রহ.) পৌঁছালে তিনি রক্ষীকে গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দির আদেশ দেন। রক্ষীর বন্দি সংবাদে মুসার রাগ আরও বেড়ে গেল। মুসা এবার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে শারিকের (রহ.) কাছে প্রেরণ করলেন। কর্মকর্তা রক্ষী গ্রেপ্তারের কারণ জিজ্ঞাসা করলে শারিক (রহ.) বললেন, আপনি একটি নাজায়েজ দাবি নিয়ে কৌফিয়ত চেয়ে বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করছেন। শারিক (রহ.) তাকেও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিলেন। গভর্নর কর্মকর্তা গ্রেপ্তারের খবর শুনে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন।
এবার গভর্নর কুফার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে ডেকে বললেন, আপনারা বিচারককে বোঝান, তিনি আমাকে অপমানিত করছেন। আমার পদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করছেন না। আমি কোনো সাধারণ লোক নই, আদালতে হাজিরা দিয়ে বেড়াব। গণ্যমান্য লোকরা শারিকের (রহ.) কাছে বার্তা পৌঁছালে তাদের বললেন, আপনারা ফেতনা করছেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করার পথে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করছেন। শরিয়তের বিপরীত কার্যক্রম করতে বলছেন। আপনাদেরও বন্দির সাজা ভোগ করতে হবে। তিনি সবাইকে বন্দির নির্দেশ দিলেন। গণ্যমান্যদের গ্রেপ্তারের সংবাদে মুসার হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল। মুসা খলিফা মাহদির চাচা ছিলেন। ক্ষমতার নেশায় মাতাল ছিলেন। তিনি সশরীরে নিজস্ব বাহিনী নিয়ে রাতের আঁধারে সব বন্দিকে বের করে নিয়ে গেলেন।
পরদিন কারারক্ষী বিচারক শারিককে (রহ.) সব ঘটনা জানালে তিনি আদালত মুলতবি ঘোষণা করে বললেন, আমি এ পদ চেয়ে গ্রহণ করিনি। খলিফা এ শর্তে আমাকে পদে বসিয়েছেন, তিনি বা তার কোনো কর্মকর্তা আমার বিচার কাজে কখনও হস্তক্ষেপ করবেন না। শারিক (রহ.) বিচারক পদে ইস্তেফা দিয়ে বাড়িতে চলে গেলেন। ইস্তেফার কারণ দর্শানোর জন্য খলিফার সঙ্গে দেখা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। গভর্নর মুসার শারিকের (রহ.) বাগদাদ যাওয়ার খবর শুনেই শুভবুদ্ধির উদয় হলো। মুসা তৎক্ষণাৎ শারিকের কাছে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বিচারক বললেন, যাদের আপনি জেল থেকে বের করে নিয়ে গেছেন তাদের ফের জেলে বন্দি করুন। নির্দেশ মতো গভর্নর তাদের বন্দি করে দিলেন! এরপর তাকে আদালতে ওই নারীর মুখোমুখি করা হলো।
গভর্নর স্বীকার করলেন, ওই নারী সঠিক বলছেন। এরপর বিচারকের আদেশ অনুযায়ী গভর্নর মহিলার বাগানের সীমানাপ্রাচীর নতুন করে নির্মাণ করে দিলেন। এ ঘটনা ইসলামের ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে।
একবার কোরাইশ গোত্রের এক মহিলা চুরি করল। গোত্রের কিছু ব্যক্তি কোরাইশদের ইজ্জত রক্ষার্থে ওই নারীকে বাঁচাতে চেষ্টায় রত হলেন। তাদের কথা মতো উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) নবী করিম (সা.) এর কাছে উপস্থিত হয়ে ওই মহিলার জন্য ক্ষমার আবেদন করলেন।
নবী করিম (সা.) বললেন, বনি ইসরাইলের ধ্বংস হওয়ার কারণ হলো, তারা গরিবদের ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত আর ধনীকে অপরাধের শাস্তি দিত না। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করে, তাহলে আমি তার ওপরও হদ কায়েম করব। এরপর নবী (সা.) ওই মহিলার হাত কর্তনের হুকুম দিলেন।
ইসলামে কখনোই পদ, বংশ, দল, ধর্ম ইত্যাদি পরিচয় দেখে ইনসাফ কায়েম করা হয় না। কাইয়ুম নিজামী নিজের ‘মালুমাতে রাসুল’ গ্রন্থে আবু বকর জাসসাসের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করে লিখেছেন, একজন মুসলমান আরেকজনের লৌহবর্ম চুরি করলেন। যখন তার প্রবল ধারণা হলো, সে ধরা পড়ে যাবে, তখন চুরিকৃত বর্মটি একজন ইহুদির বাড়িতে গোপনে রেখে দিলেন। ফলে লৌহবর্মটি ইহুদির ঘর থেকেই উদ্ধার হলো, অথচ ইহুদি চুরির কথা অস্বীকার করছে! মূল চোর নিরপরাধ ইহুদিকে ফাঁসানোর জন্য নিজের পক্ষে কিছু মুসলমানকে জড়ো করল। আল্লাহ তায়ালা ওহির মাধ্যমে ইহুদিকে নিরপরাধ সাব্যস্ত করলেন।
পবিত্র কোরআনের জায়গায় জায়গায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আদেশ করা হয়েছে। এ আদেশই ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলিম-অমুসলিম সবার অধিকার রক্ষার গ্যারান্টি। কোরআনের হুকুমের কারণেই শারিকসহ (রহ.) পৃথিবীর সব বিচারক ন্যায়বিচার করে থাকেন। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, আজকে যারা নিজেদের দেশকে ‘মদিনা রাষ্ট্র’ রূপে প্রতিষ্ঠার দাবি করেন, আপনাদের দৃষ্টিতে তাদের কথা ও কাজে শারিকের (রহ.) বিচার পদ্ধতি ধরা পড়ে, নাকি কুফার গভর্নর মুসার অবৈধ ক্ষমা প্রদর্শনের ঝলক দৃষ্টিগোচর হয়?
নিজেদের আশপাশে একটু দৃষ্টিপাত করুন। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত, কোথাও কি মজলুমের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব? ‘ন্যাব’ (ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টাবিলিটি ব্যুরো) থেকে শুরু করে ইলেকশন কমিশন কোথাও দ্রুত ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব? ‘ন্যাব’কে শুরু দিন থেকেই রাজনৈতিকবিরোধী পক্ষকে ‘সবক’ শেখানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ন্যাবের ‘পলিটিক্যাল ইঞ্জিয়ারিংয়ের’ সাক্ষ্য তো সুপ্রিমকোর্টের সম্মানিত জজ সাহেবরাও দিয়ে দিয়েছেন!
ইলেকশন কমিশনে ২০১৪ সাল থেকে তাহরিকে ইনসাফের বিরুদ্ধে ফরেন ফান্ডিং মামলা মুলতবি রয়েছে। ‘মদিনা রাষ্ট্রের’ প্রবক্তা দল তাহরিকে ইনসাফের উচিত ছিল, ওই মামলা ঝুলিয়ে ও গোপন না রেখে বরং ইলেকশন কমিশন বরাবর দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির আবেদন করা। সেখানে উল্টো ইলেকশন কমিশন ওই মামলা ৬ বছর ঝুলিয়ে রেখে নিজেদের তামাশার পাত্র বানিয়ে রেখেছে।
পাকিস্তানের শীর্ষ দৈনিক রোজনামা জঙ্গে প্রকাশিত কলাম থেকে অনুবাদ আমিরুল ইসলাম লুকমান