নবীজি (সা.) তাঁর দুই মেয়েকে বিয়ে দেন মক্কার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির কাছে, অন্যদিকে তাঁর ছোট মেয়েকে এমন একজনের সঙ্গে বিয়ে দেন, যার মোহরানা দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না। তিনি রুকাইয়্যা এবং উম্মে কুলসুমকে (রা.) বিয়ে দেন উসমানের (রা.) সঙ্গে, যাকে মক্কার লোকরা ‘গণি’ বলত। গণি মানে হলো ধনী, আমাদের সময়ে আমরা যেমন ‘কোটিপতি’ বলি, তেমনি মক্কার লোকেরা উসমান (রা.) কে বলত উসমান গণি (রা.)। রুকাইয়্যা এবং উম্মে কুলসুম (রা.) মারা যাওয়ার পর শোকাহত উসমানকে (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার যদি আর কোনো মেয়ে থাকত, তাঁকেও আমি তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতাম।’ [আসহাবে রাসুলের জীবনকথা : ১/৪২]।
উসমান (রা.) ধনী ছিলেন, শুধু এ কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর কন্যাদ্বয়কে উসমানের (রা.) সঙ্গে বিয়ে দেননি। তারচেয়ে বড় কথা হলো, উসমান (রা.) ছিলেন দ্বীনদার, চরিত্রবান, লজ্জাশীল। তার মধ্যে অনেকগুলো ভালো গুণের সমন্বয় ছিল। তিনি এতটা লজ্জাশীল ছিলেন যে, ফেরেশতারা তাঁকে দেখে লজ্জা পেত। (তিরমিজি : ৩৭১৪)।
অন্যদিকে আলী (রা.) ছিলেন খুব দরিদ্র। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সবচেয়ে আদরের ছোট মেয়ে ফাতিমাকে (রা.) যখন আলীর (রা.) সঙ্গে বিয়ে দেন, তখন আলীর (রা.) দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না। বিয়ের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) আলীকে (রা.) বলেন, ‘ফাতিমাকে কিছু দাও।’
আলী (রা.) বললেন, ‘তাঁকে দেওয়ার মতো তো আমার কাছে কিছু নেই।’
- তোমার বর্মটি কোথায়?
- এটা তো আমার কাছে আছে।
- তাহলে তাঁকে এটা দিয়ে দাও। (নাসাঈ : ৩৩৭৫)।
মাত্র একটা বর্ম ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষের মেয়ের মোহরানা। যেই মেয়ে ছিল তাঁর চোখের মণি, তাঁকে তিনি তুলে দিলেন একজন ‘গরিব’ পাত্রের হাতে। সেই পাত্রের কী এমন গুণ ছিল? বিয়ের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর মেয়েকে ওই পাত্রের গুণগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেন, ‘ফাতিমা! আমি তোমাকে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, সবচেয়ে বিচক্ষণ এবং প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি।’ (আসহাবে রাসুলের জীবনকথা : ৬/৪৩)।
তারমানে রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন পাত্রদ্বয়ের সঙ্গে নিজের মেয়েকে বিয়ে দেন, যারা ছিলেন দ্বীনদার, চরিত্রবান, জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ। ‘পাত্র ধনী কি-না’ এটা শর্ত ছিল না। পাত্র যদি দ্বীনদার, চরিত্রবান, জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ হওয়ার পাশাপাশি ধনী হয়, তাহলে তো নুরুন আলা নুর, সোনায় সোহাগা।
অর্থ-সম্পদের ভিত্তিতে ব্যক্তির মান-মর্যাদা নির্ধারণ আমাদের সময়ে যেমন আছে, তেমনি রাসুলের (সা.) সময়ও ছিল। এমনকি সাহাবিরাও এমনটা মনে করতেন। একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে ছিলেন। একব্যক্তি তাঁদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওই ব্যক্তিটি সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা?’ সাহাবিরা জবাব দিলেন, ‘এই ব্যক্তি যদি কোনো মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তাহলে তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে। যদি সে সুপারিশ করে, তাহলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। যদি সে কথা বলে, তাহলে তার কথা শোনা হবে।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) কিছু বললেন না। সাহাবিদের মানসিকতা শুধু পর্যবেক্ষণ করলেন।
কিছুক্ষণ পর আরেকজন লোক তাঁদের পাশ দিয়ে গেল। এই লোকটি ছিলেন গরিব। আবার রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এই লোকটি সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা?’ সাহাবিরা জবাব দিলেন, ‘এই ব্যক্তিটি যদি কোথাও বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তাহলে তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে না। যদি সে সুপারিশ করে, তাহলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না। যদি সে কথা বলে, তাহলে তার কথা শোনা হবে না।’
দেখুন, সাহাবিরা ছিলেন উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ। তারাও মনে করতেন, সমাজে একজন লোকের মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্ভর করে অর্থ-সম্পদের ওপর। বিত্তশালী কারও বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে, গরিবদের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের এরকম মানসিকতা বদলে দিলেন। সাহাবিরা যে ‘বাটখারা’ দিয়ে মানুষ মাপছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) সেই বাটখারাটি দূরে রেখে অন্য একটা বাটখারা দিয়ে তিনি দুই ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করলেন। তিনি বললেন, ‘দুনিয়া ভর্তি ওই ধনীদের চেয়ে এই গরিব লোকটি উত্তম।’ (বোখারি : ৫০৯১)।
এই যে রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের ব্যাপারে, এমনকি পাত্রের ব্যাপারে সাহাবিদের মানসিকতা পরিবর্তন করে দেন তার প্রভাব সাহাবিদের ওপর পড়ে। আবু দারদার (রা.) মেয়ে দারদাকে বিয়ে করার জন্য খলিফা ইয়াযিদ ইবনে মু’আবিয়া প্রস্তাব দেয়। আমাদের সময়ের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করুন, একজন প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী একজন মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। আবু দারদা (রা.) চিন্তা করলেন, মেয়েকে রাজপরিবারে বিয়ে দিলে তাঁর দ্বীনদারিতার ক্ষতি হতে পারে। এজন্য তিনি খলিফার সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে একজন সাধারণ মুসলিমের সঙ্গে বিয়ে দেন, যে তাঁর মেয়ের দ্বীনদারিতা রক্ষা করতে পারবে। (সিফাতুস সাফওয়াহ : ১/২৬০)।
বিখ্যাত তাবেঈ সায়িদ ইবনে মুসায়্যিবের (রহ.) মেয়েকে বিয়ে করার জন্য খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক প্রস্তাব দেন। কিন্তু, তিনি মেয়েকে খলিফার সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে তাঁর এক গরিব ছাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেন, যার দেনমোহর দেওয়ার সামর্থ্য ছিল মাত্র চার দিরহাম। (তাবিঈদের জীবনকথা : ১/৯৯-১০০)।
মনে করুন, আপনি কক্সবাজার ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান করছেন। জনপতি খরচ পড়বে ৩ হাজার টাকা। আপনার হাতে আছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু ট্যুরে গেলে তো এক্সট্রা খরচ আছে। এই ৫০০ টাকায় হবে? এই মুহূর্তে ট্যুরে যাবেন কি-না এটা নিয়ে আপনি দ্বিধায় আছেন। একবার মনে হচ্ছে যাই, তো আরেকবার মনে হচ্ছে কক্সবাজার গিয়ে বিপদে পড়ে যদি টাকা লাগে, তখন টাকা কোথায় পাব? ঠিক এমন সময় আপনার বাড়িতে আপনার কোটিপতি চাচা এলেন। আপনার দ্বিধা-সংকোচ দেখে তিনি বললেন, ‘দূর বেটা! যা ঘুরে আয়। আমার কাছে এখন ক্যাশ নেই, ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলতে হবে। কক্সবাজার গিয়ে আমাকে ফোন দিস, তোর বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেব।’
আপনার চাচা বিশ্বস্ত। কথা দিয়ে কথা রাখেন। এখন বলুন, চাচার আশ্বাস পেয়ে আপনি কক্সবাজার যাবেন না? অবশ্যই যাবেন। কারণ, চাচাকে একটা ফোন দিলে ১০-১৫ হাজার টাকা আপনার মোবাইলে চলে আসবে। আল্লাহ পবিত্র কোআনে বলেন ‘তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিত নারী-পুরুষ ও সৎকর্মশীল দাস-দাসীদের বিয়ে দিয়ে দাও। তারা অভাবী হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও মহাজ্ঞানী।’ (সুরা আন-নূর : ৩২)।
সমাজ বলে ‘চাকরি না পেয়ে বিয়ে করবা কেন?’ বাবা-মা বলে, ‘বিয়ে করে বউকে কী খাওয়াবা?’ মেয়েপক্ষ বলে, ‘ছেলে সরকারি চাকরি করে কি-না?’ এগুলো বলে বিয়েকে সমাজে ‘লকডাউন’ করে রাখা হয়েছে। সবগুলো প্রশ্নের মূল প্রশ্ন একটাই রিজিকের চিন্তা। অথচ আল্লাহ বিয়ের ব্যাপারে ‘গ্যারান্টি’ দিচ্ছেন বিয়ে করো, রিজিক নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, অভাবী হলে আমি অভাবমুক্ত করব (অবশ্য তাই বলে বিয়ে করে ঘরে বসে থাকবেন, আল্লাহ রিজিক দিয়ে দিবেন, এটাও না)।
আমরা কোটিপতি চাচার আশ্বাসকে বিশ্বাস করে ট্যুরে চলে যাই। অথচ যিনি আমাদের রিজিক দেন, যিনি আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিকে রিজিক দেন, যিনি পানির নিচের প্রাণীকে রিজিক দেন, তিনি আশ্বাস দিচ্ছেন বিয়ে করলে আমি তোমাদের অভাবমুক্ত করব; কিন্তু আমরা তাঁর আশ্বাসকে বিশ্বাস করতে পারছি না! সমাজের মুডকে আমরা ‘গড’ বানিয়ে নিয়েছি। সমাজের মুড যতটা ইসলামের সঙ্গে যায়, ততটা মানছি। সমাজের যেই মুড ইসলামের সঙ্গে যায় না, সেক্ষেত্রে আমরা ইসলাম ছেড়ে সমাজকে মানা শুরু করি। ক্রমে আমরা হয়ে উঠি সমাজপূজারি!
অভাবগ্রস্ত সাহাবি একজন আরেকজনের কাছে গিয়ে সাজেশন চাইতেন। ‘কী করব বল?’ তখন একজন বলতেন, ‘তুমি কী বিয়ে করেছ?’ উনি যদি ‘না’ বলতেন তাহলে উপদেশদাতা বলতেন, ‘তুমি বিয়েই করোনি, তাহলে তুমি অভাবমুক্ত হবে কীভাবে? তুমি কি কোআনে পড়োনি, অভাবমুক্ত হওয়ার একটা উপায় হলো বিয়ে করা?’ তারপর ওই সাহাবি গিয়ে বিয়ে করতেন, দেখা যেত কিছুদিন পর তিনি অভাবমুক্ত হয়ে যেতেন। কিন্তু, আমাদের সমাজ শেখায়, আগে সচ্ছল হও, বউকে খাওয়ানোর মতো টাকা-পয়সা জমাও, তারপর বিয়ের নাম নিও। তাহলে, সেই সমাজকে জিজ্ঞেস করুন, কোরআনের উপরোক্ত আয়াতটি নিয়ে তোমার ‘তফসির’ কী? রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের সবচেয়ে আদরের মেয়ে ফাতিমাকে (রা.) একজন অভাবগ্রস্তের হাতে তুলে দিয়েছেন, এটার ব্যাখ্যা কী? রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর প্রিয় সাহাবি যুলাইবিব (রা.), যার হাতে কানাকড়ি ছিল না, তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, এটার ব্যাখ্যা কী?
সমাজ এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে ব্যর্থ হওয়ার পরও যদি আপনি সমাজের সঙ্গে সুর মিলিয়ে চলেন, তাহলে আপনাকে আরও দুটো কথা বলে আমি লেখাটি শেষ করছি। যারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও বিয়ে করতে পারছেন না, তাদের দুটো ক্যাটাগরিতে রাখা যায়। হয় তারা রোজা রেখে সংযম করছেন, নয়তো তারা সুযোগ পেলে ঋড়ৎহরপধঃরড়হ-এ লিপ্ত হচ্ছেন, সুযোগ না পেলে গধংঃঁৎনধঃরড়হ-এ (এ দুটোর অনুবাদ-ব্যাখ্যা করছি না, না জানলে গুগলে সার্চ দিয়ে জেনে নেবেন)।
এর দায়ভার কার ওপর বর্তাবে? হ্যাঁ, পাপের ভাগ পাপীর ওপর যেমন বর্তাবে, তেমনি পাপীর বাবার ওপর।
আবু সাঈদ খুদরি এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও (অবহেলাবশত) বাবা যদি তার সন্তানকে বিয়ে না করায়, তাহলে সে (সন্তান) যদি পাপ কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে এর গোনাহ পিতার ওপর বর্তাবে।’ [বায়হাকি]।