ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বঙ্গবন্ধু : সর্বশ্রেষ্ঠ মহত্তম শহীদ

সামছুল আলম দুদু এমপি
বঙ্গবন্ধু : সর্বশ্রেষ্ঠ মহত্তম শহীদ

আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই হচ্ছেন স্মরণাতীতকালের মানব জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মহত্তম শহীদ। আজ বিশ্বে এটা স্বীকৃত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নিন্দনীয় ও অভিশপ্ত প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধুর শহীদ হওয়ার যৌক্তিকতা বিশ্লেষণের জন্য এই উপমহাদেশের বঙ্গবন্ধুর সমকালীন পর্যায়ে তার মতো ব্যক্তিত্বের জন্ম বিকাশ আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই বঙ্গবন্ধুর উত্থান ও বিকাশের পেছনে অবিকৃত সাক্ষ্য তুলে ধরা না হলে ইতিহাসে তাকে যথার্থ মূল্যায়ন সম্ভব নয়। এ যাবৎ তাকে নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। এ কথা অজানা নয় যে, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নির্বিশেষে সকল প্রকার অবিচার অবিমৃশ্যকারিতা ও অপরাধ প্রতিরোধ তথা বিরোধিতা করার মানিসিকতায় বাল্যকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু বেড়ে উঠছিলেন। তদানীন্তন সামাজিক বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদের প্রাথমিক স্তর ছিল সাম্প্রদায়িক বিচ্যুতির বিরুদ্ধে।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে গোড়ার দিকে তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের আপসহীন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। সে সময় কার্যত মুসলিম লীগই ছিল মুসলমানদের একমাত্র প্ল্যাটফর্ম। পর্দার পেছনে ব্রিটিশদের কলকাঠি নাড়ার কারণে উভয় সম্প্রদায়ের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিভাত হয়। সাম্প্রদায়িক কারণে উপমহাদেশকে খণ্ডবিখণ্ড করে রেখে যাওয়ার ব্রিটিশ কূটবুদ্ধিপ্রসূত পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে তিন খণ্ডে দুটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

সে সময় তরুণ শেখ মুজিব ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, দ্রুত এবং স্বংক্রিয়ভাবে শিক্ষিত সুদর্শন অবাঙালি মুসলমানরা বিশ্বাসঘাতকতায় সংক্রমিত হবে। কেননা ব্রিটিশ শাসনকালে শিক্ষিত মার্জিত সুদর্শন উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্রিয়াকলাপ দেখেছেন এবং নানা বিষয়ে শেখ মুজিবের অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিল পরিপূর্ণ তরুণ বয়সেই। তিনি তার দর্শন দিয়েই উপলব্ধির প্রয়াস পান যে, অবাঙালি শিক্ষিত মুসলমান এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে রুচিগত কোনো তফাৎ নেই। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হন এবং সে সময়কার এই প্রতিবাদীকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে সাব্যস্ত করে শাসকগোষ্ঠী। ৪০-এর দশকের শেষ দিকে সোহরাওয়ার্দী যখন ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে পূর্ববঙ্গে আশ্রয় নেন, তখন মুসলিম লীগ নেতাদের অপকর্ম প্রতিরোধের লক্ষ্যে সোহরওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিম লীগের পত্তন করেন। তরুন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক হন। আপসহীন ব্যক্তিত্ব রূপে শেখ মুজিব বিকশিত হন। আওয়ামী মুসলিম লীগ পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়ে বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন শুরু করে। সকল প্রতিথযশা নেতৃবৃন্দকে ডিঙিয়ে বঙ্গবন্ধু শীর্ষ স্থানটিতে অভিষিক্ত হন তার নিজস্ব যোগ্যতা ও মেধার কারণে।

এর পরপরই করাচি কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে পূর্ববঙ্গ সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে কারাবন্দি করা হয়, তারপর থেকে দ্বিতীয় আবাস হিসেবে কারাগরই নির্দিষ্ট হয় বঙ্গবন্ধুর জন্য। পঁচিশ বছর স্থায়ী পাকিস্তানের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ১৪ বছর কাল কারাগারে কাটান বঙ্গবন্ধু। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কারণে এত বছর কাল কারা জীবন রাজনীতির ইতিহাসে বিরল ঘটনা। সোহরাওয়ার্দীর জীবদ্দশায়ই বঙ্গবন্ধু এমন সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেন, যাতে তার আসন নির্দিষ্ট হয়ে যায় সবার ওপরে। সমকালীন পূর্ববঙ্গ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যারা বঙ্গবন্ধুর কনটেমপোরারি ছিলেন, তাদের অনেকের শিক্ষা-দীক্ষা ও ঐতিহ্য বঙ্গবন্ধুর ওপরে হলেও বঙ্গবন্ধুকে কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেননি, বরং বঙ্গবন্ধু তার কমরেডদের বিশ্বাসঘাতকতার পটভূমিতে দৈহিক ও মানসিকভাবে একমাত্র নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হন। উল্লেখ্য, ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে যখন ফিল্ড মার্শাল আইউব খান ক্ষমতা দখল করেন, তখন একমাত্র এইচএস সোহরাওয়ার্দী এবং তার দল আওয়ামী লীগই সামরিক কর্তৃপক্ষের বুলডোজারের আঘাতে জরাজীর্ণ হন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জুলফিকার আলী ভুট্টো সোহরাওয়ার্দী ও তার দলের কমরেডদের চরিত্র হনন শুরু করেন পরিকল্পিত উপায়ে। জেড এ ভুট্টো তার বাক্যকুশলতায় পাকিস্তান রক্ষার অস্ত্র হিসেবে সামরিক আইনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। এ সময় নিঃসঙ্গ পরিবেশে বৈরুতের নির্জন হোটেল কক্ষে সোহরওয়ার্দীর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয় রহস্যজনকভাবে। এর পর থেকে পাকিস্তানের সামরিক আমলা, শিল্পপতি চক্রের ক্ষমতা সুসংহত করা সহজ হয়। আর এ প্রক্রিয়ায় অপ্রতিদ্বন্দ¦ী নেতা ছিলেন এজেড ভুট্টো। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শূন্যতার পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন ও দলকে পুনরুজ্জীবিত করে পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার কাজ এককভাবে সফলতার সঙ্গে সম্পাদন করতে সক্ষম হন। বঙ্গবন্ধু তার দলের প্রবীণ যোগ্য ও অভিজ্ঞ নেতাদের বাদ দিয়ে তরুণ সমর্থক বেছে নিয়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নতুনভাবে গড়ে তোলেন দলকে। প্রবীণ ও অভিজ্ঞদের বাদ দেওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, এরা সূর্যালোকে থেকেও ব্যক্তি ও পারিবারিক পরিমণ্ডলের পরিপুষ্টিতে অবদান রেখেছেন, যা কি-না পাকিস্তানে প্রথম সামরিক আইন জারির পরোক্ষ কারণও বটে। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, রাজনীতিকরা যদি পারিবারিক জীবনের সমৃদ্ধিকরণে মনোযোগী হন, তবে তাদের দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির এ দর্শন চিরন্তন। বঙ্গবন্ধু এবং তার তরুণ কমরেডদের গৌরবময় ত্যাগ ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ। বঙ্গবন্ধু ও তার কমরেডদের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন সময় কারাগারের প্রেরণ করলেও বঙ্গবন্ধুর প্রজ্জ্বলিত অর্নিবাণ শিখা কখসও নিভে যায়নি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে জড়ানো ছিল পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক। সামরিক শাসনের মাধ্যমে নির্যাতনের একমাত্র লক্ষ্যই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সমাপ্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাফল্যজনক আলোচনার পরও ইয়াহিয়া বিবেকবর্জিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। ২৫ মার্চের কালরাতে বাঙালির প্রিয় নেতাকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিক্ষেপ করে। কিন্তু এর মধ্যে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ঘোষণাটি দিয়ে যেতে সক্ষম হন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ৯ মাসের মধ্যে ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। এখানে দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা চলে যে, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যদি বাংলাদেশে না এসে পৌঁছতেন তাহলে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসজ্জিত পরস্পরবিরোধী আদর্শের অনুসৃত দল, গ্রুপ ও ক্লিকের মধ্যকার সংঘাতজনিত যুদ্ধে বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যেত সম্পূর্ণরূপে। বঙ্গবন্ধুর নামের জাদুতেই আধুনিক রাষ্ট্রের অবকাঠামো ছাড়াই বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে ওঠে। এদিকে বাংলাদেশি সকল সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের ভুট্টো পাকিস্তানে আটকে রেখেছিলেন এবং বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে তার দোসরদের দ্বারা প্রগতিশীল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করান এই কারণে যে, বঙ্গবন্ধু যেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হন। ভুট্টোর অনুগত কিছু রাজনীতিবিদ সামরিক-বেসামরিক আমলা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে যোগ দেন মূলত, এরাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকারকে অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ণ করে তুলতে ষড়যন্ত্র করেন। বঙ্গবন্ধুকে অনেকটাই অজনপ্রিয় করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির হৃদয় মন্দিরে অনেক আগেই ঠাঁই করে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা গ্রহণ করে পূর্ব বাংলায় যে সমস্ত সাধারণ মানের আমলাদের কর্মরত দেখতে পান, তাদের মধ্যেও অনেকে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎসাহ প্রণোদিত সমর্থন দেননি। এক আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনায় সু-কঠিন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসক বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ফলে তাকে এককভাবেই এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর অনুরাগীদের মধ্যকার মানব ইতিহাসের জঘন্যতম ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতকেরা বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি তৈরি করে। কিন্তু নিজেদের অজ্ঞাতেই আবার বঙ্গবন্ধুকে আমাদের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শহীদে পরিণত করেন। বঙ্গবন্ধুর পর যারা বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন, তারা কৃতজ্ঞাতার ঋণ পরিশোধ করেন বঙ্গবন্ধুকে দোষারোপ করার মাধ্যমে। ধীরস্থির বস্তুনিষ্ঠ এবং রাজনীতিক মূল্যায়নে আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এই সত্য উপলব্ধিতে উপনীত হতে পারি যে, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি পারস্পরিক আস্থার পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর যা কারণীয় ছিল, তিনি সেটাই করেছেন। তাকে এ ব্যাপারে কেউ কোনো পরামর্শ দেয়নি। মহান বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি; যিনি তাঁর বিশ্বাসের জন্যই আত্মত্যাগ করতে পেরেছেন এবং যার ইসলামের প্রতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য ছিল।

একথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। শ্রদ্ধা জানাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অন্যান্য যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রতি, শ্রদ্ধা জানাই ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় ঘাতক কর্তৃক নিহত চার নেতার প্রতি, শ্রদ্ধা জানাই ২০০৪ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় নিহত শহীদদের প্রতি। সেই সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাই স্বাধীনতা সংগ্রামে ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের প্রতি। একটি কথা আজ মনে রাখতে হবে যে, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর ও ২০০৪ সালের ২১ আগস্টসহ সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে দেশীয় আন্তর্জাতিক পারস্পরিক দেশবিরোধী চক্রান্তের যোগসূত্র বিদ্যমান ছিল। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে শিখা বঙ্গবন্ধু প্রজ্জ্বলিত করে গেছেন, তার আলোয় উদ্ভাসিত হবে সারা বিশ্ব। যে সময়ে বঙ্গবন্ধু শাহাদতবরণ করেন, সে সময়টা পরম করুণাময়ের অনুগ্রহভাজন গুটিকয়েক মানুষের জন্যই নির্দিষ্ট। জাতীয় শোক দিবসের ভাবনায় নতুন করে প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হয়ে আসছে। এ শক্তি যুগে যুগেই সঞ্চারিত হবে।

লেখক : রাজনীতিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত