প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫
ইমরান ছিলেন বনি ইসরায়েলের বুজুর্গ ও আবেদ ব্যক্তি। মসজিদে নামাজ পড়াতেন তিনি। তার সংসারত্যাগী ও ইবাদতের কথা লোক মুখে চাউর ছিল। স্ত্রী হান্নাহও অত্যন্ত পরহেজগার ও আবেদা ছিলেন। তাদের একমাত্র বুকের ধন মেয়ে মরিয়ম (আ.)। জীবনভর আকাঙ্ক্ষা, প্রার্থনা ও চোখের জলের বিনিময়ে আল্লহর রহমতে পেয়েছিলেন মরিয়মকে। মান্নত পূরণে মসজিদুল আকসার সেবায় দিয়েছিলেন তাকে। মরিয়ম (আ.) জাকারিয়া (আ.)-এর তত্ত্বাবধানে মসজিদুল আকসার একটি ঘরে থাকতেন। দিনমান আমল-ইবাদত করতেন।
রাতের বেলা খালার বাসায় চলে যেতেন। তার খালা ইশা জাকারিয়া (আ.)-এর স্ত্রী। (কাসাসুল কোরআন, মাওলানা হিফজুর রহমান, অনুবাদ : আব্দুস সাত্তার আইনী, খণ্ড: ১০, পৃষ্ঠা : ১৩)।
মসজিদুল আকসার যে ঘরে মরিয়ম (আ.) ইবাদত করতেন, মাঝেমধ্যে জাকারিয়া (আ.) যেতেন। খোঁজ নিতেন। কুশল জানতেন। সেখানে গিয়ে অধিকাংশ সময় বিস্ময়ে হতবাক হতেন তিনি। তার ঘরে এমন সব বাহারি তাজা ফলের আয়োজন পেতেন, যেগুলোর মৌসুম তখন ছিল না। শীতকালের ফল গ্রীষ্মকালে এবং গ্রীস্মকালের ফল শীতকালে দেখতে পেতেন। তিনি ব্যাপারটি জানতে চাইলেন। মরিয়ম (আ.) জানালেন, ‘এটা প্রতিপালকের অনুগ্রহের দান। তিনি যাকে ইচ্ছা বে-হিসাব রিজিক দেন।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড : ৭, পৃষ্ঠা : ৪১)।
মরিয়ম (আ.)-এর প্রতি জাকারিয়া (আ.)-এর মুগ্ধতা, স্নেহ, সম্মান ও বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। এমন নেক সন্তানের জন্য তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। অথচ তিনি ও তার স্ত্রী তখন বৃদ্ধ। চুল কাশফুলের মতো শুভ্র। হাড়ে ক্ষয় ধরেছে। যে আল্লাহ মৌসুম ছাড়া ফল দিতে পারেন, তিনি বৃদ্ধকে দিতে পারেন সন্তান-এই আত্মবিশ্বাসের অবিচলতায় তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। আল্লাহ তাকে ছেলে দেন। নাম রেখে দেন ইয়াহইয়া।
মরিয়ম (আ.) দীর্ঘকাল মসজিদুল আকসায় দায়িত্ব পালন করলেন। পবিত্র জীবনযাপন করলেন। ইবাদতে ব্যস্ত থাকলেন। আল্লাহ তাকে পবিত্র রেখেছেন এবং পবিত্র করেছেন। নারীদের মধ্যে মনোনীত করেছেন। তার পবিত্রতার ঘোষণা আল্লাহ নিজে কোরআনে দিয়েছেন। ফলে তার চরিত্রের পবিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন করা অবিশ্বাসী অভিশপ্তদের কাজ। বিশ্বাসী মানুষ তার চরিত্র নিয়ে কোনো কালে প্রশ্ন তুলতে পারে না। (সুরা আলে ইমরান : ৪৩)।
মরিয়ম (আ.) নির্জন ঘরে সব সময় ইবাদতে মশগুল থাকতেন। একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বের হতেন না।
একবার বিশেষ প্রয়োজনে মসজিদের পূর্বদিকে মানুষের আড়ালে গিয়ে বসলেন। এ সময় এক যুবক এসে দাঁড়ালেন সামনে। তিনি যুবককে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তাকে আল্লাহর কথা বললেন। পরকালের ভয় দেখালেন। যুবক বললেন, ‘আমি আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাইল। তুমি ভয় করো না। আমি তোমাকে ছেলেসন্তানের সুসংবাদ দিতে এসেছি।’ তিনি বিস্ময়ে বললেন, ‘এটা কীভাবে সম্ভব! আমাকে আজ পর্যন্ত কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি। আমার বিয়েও হয়নি। আমি ব্যভিচারীও নই।’ জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘তোমার প্রতিপালকের ইচ্ছা। প্রতিপালক তোমার ছেলেকে বিশ্বজগতের অলৌলিকতার নিদর্শন বানাবেন।’
জিবরাইল (আ.) তাকে ছেলের কিছু বৈশিষ্ট্য ও গুণের কথা বলেন। যথা- ছেলে জগতের জন্য রহমত হবে। আল্লাহর কালিমা (সাধারণ প্রজনন ও জন্মগ্রহণের নিয়ম থেকে ভিন্ন আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতার নীতি অনুযায়ী আল্লাহর হুকুম ও ইচ্ছায়ই তিনি মরিয়মের গর্ভে আসবেন) হবে। তার উপাধি হবে মাসিহ (বরকতময় বা পর্যটক, যার কোনো অবস্থান নেই), নাম ইসা। দুনিয়া-আখেরাতে মর্যাদাবান হবে। আল্লাহর ঘনিষ্ঠজন হবে। মাতৃস্তন্যপায়ী বয়সে মানুষের সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলবেন। আল্লাহ তাঁকে কিতাব দেবেন। তাঁকে প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবেন। বনি ইসরায়েলের নবি বানাবেন। (সুরা আলে ইমরান : ৪৫-৪৯)।
জিবরাইল (আ.) মরিয়ম (আ.)-কে সুসংবাদ দিয়ে তার জামার বুকের অংশে ফুঁক দেন। (সুরা আম্বিয়া : ৯১)। আল্লাহর কালিমা তার মধ্যে প্রবেশ করে। কিছু দিন পর তিনি গর্ভবতী হন। অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েন। চিন্তায় মুষড়ে পড়েন। দিন দিন সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসে। মানুষ তাকে অপবাদ দেবে- এ ভয়ে একদিন জনপদ ছাড়লেন। মসজিদ থেকে নয় মাইল দূরে জর্দান নদীর পশ্চিত তীরের সারাত বা সাইর (যা বর্তমানে বায়তুল লাহাম বা বেথেলহাম) গেলেন। কয়েক দিন পর তার প্রসব বেদনা শুরু হলো। প্রচণ্ডরকম যন্ত্রণা ও অস্থিরতা পেয়ে বসল তাকে। একটি খেজুর গাছের ডাল ধরে বসে পড়লেন।
সাইর পর্বত তখন শুষ্ক মরুভূমি। আশপাশে পানি নেই। খাবারের কিছু নেই। যে খেজুর গাছের নিচে বসে আছেন, সেটি পাতা ঝরে শুকিয়ে আছে। খেজুর আসার বার্তা নেই। মরিয়ম (আ.)-এর সঙ্গেও খাবার নেই; যা ছিল ফুরিয়ে গেছে এর মধ্যে। একদিকে প্রসব বেদনা, অন্যদিকে ক্ষুধার কষ্ট। জাতির লোকেরা চরিত্র কলুষিত করবে আর অপবাদ দেবে; এ ভয়ে তিনি মরে যেতে চাইলেন। মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা করলেন। আল্লাহ তার পায়ের কাছে পানির নহর সৃষ্টি করলেন। খেজুর গাছ ভরে দিলেন পাকা ও তাজা খেজুরে। গাছের ডাল ধরে নিজের দিকে নাড়া দিলেই ঝরতে থাকবে পাকা ও তাজা খেজুর। এর মধ্যে ইসা (আ.)-কে প্রসব করলেন। শিশুকে দেখে প্রাণ জুড়ালো তার। মন আনন্দিত হলো। দুঃখ দূর হলো। আতঙ্ক ও উদ্বেগ উবে গেল। পরক্ষণেই চিন্তার ভাঁজ পড়ল মনে। এই পবিত্র ও অনিন্দ্য সুন্দর শিশুকে কীভাবে নেবে জাতির লোকরা। পিতার সংস্পর্শ ছাড়া মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান জন্ম নিতে পারে, এটি জাতিকে বুঝাবেন কি করে!
আল্লাহ মরিয়ম (আ.)-এর কাছে ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতা সান্ত¡না দিলেন। বললেন, ‘সম্প্রদায়ের লোকেরা শিশুর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তুমি উত্তর দেবে না। ইঙ্গিতে তাদের জানিয়ে দিও, তুমি রোজাদার। শিশুকে জিজ্ঞেস করতে বলবে।’ তিনি অহির বার্তা পেয়ে সদ্যজাত শিশুকে নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে পথ চললেন। শহরে পৌঁছার পর লোকেরা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল তাকে। কেউ বলল, ‘তুমি এটা কী করলে মরিয়ম। বড় বিস্ময়ের কাণ্ড ঘটিয়ে দিলে। মারাত্মক দুর্নামের কাজ করে ফেলেছ।’ কেউ কেউ বলল, ‘তোমার বাবা তো খারাপ লোক ছিলেন না। তোমার মাও ব্যভিচারী ছিলেন না।
তুমি এমন করতে পারলে।’ মরিয়ম (আ.) রোজার ব্যাপারটি জানিয়ে কারও কথার উত্তর না দিয়ে শিশুর দিকে ইশারা করলেন। তারা অবাক হয়ে বললেন, ‘এই দুগ্ধপোষ্য শিশু কীভাবে কথা বলবে।’ শিশু তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, ‘আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন। আমাকে নবি বানিয়েছেন।’ আরও অনেক কথা বললেন শিশুটি। তারা শিশুর মুখে এমন জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে চমকে গেলেন। বিস্ময়ে হতবাক হলেন। তারা বিশ্বাস করলেন, মরিয়ম সম্পূর্ণ পবিত্র। এই শিশু আল্লাহর নির্দশন। (সুরা মরিয়ম, আয়াত: ২২-৩৩; তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড : ৭, পৃষ্ঠা : ৫৪-৫৬)।