ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/২৭)

পরীর দেশে আব্দুল গউস

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
পরীর দেশে আব্দুল গউস

নাম আব্দুল গউস। তাকে ঘিরে সাজানো এই রূপকথা। মওলানা রুমি মসনবিতে তার জীবনদর্শন উপস্থাপনে সাহায্য নিয়েছেন এই রূপকথার। আব্দুল গউস মানুষ হলেও তার মধ্যে ছিল জিনপরীর স্বভাব। তাই সর্বদা মনের গহিনে লালন করত কোথাও উড়াল দেওয়ার বাসনা। আধুনিক বিজ্ঞান বলে, মানুষের স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করে অদৃশ্য জিন আর হরমোন। সম্ভবত আব্দুল গউসের দেহেও ছিল এ ধরনের ব্যতিক্রমী হরমোন।

হঠাৎ একদিন খবর হলো, আব্দুল গউস নেই। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী আত্মীয়রা চারদিকে খোঁজাখুঁজি করে। নিরাশ হয়ে একপর্যায়ে স্ত্রী অন্য স্বামীর ঘরে চলে যায়। এতিম ছেলেমেয়েরা নানা কথার ছলে মনে সান্ত¡না খুঁজে বেড়ায়। কেউ বলে নেকড়ে খেয়ে ফেলেছে বাবাকে। অথবা ডাকাত দলের হাতে নিহত হয়েছে। কারও ধারণা পরিত্যক্ত গভীর কূপে পড়ে উঠে আসতে পারেননি। কিংবা শত্রুরা ওঁতপেতে হত্যা করে তার লাশ গুম করেছে। আসলে অশরীরি পরীরা নিয়ে গেছে পরীর দেশে। তাই তার হদিস নেই কোনো দিকে। শেষ পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের বাবা বলে কেউ ছিল- এমন কথা ভুলে থাকার মধ্যে মনের শান্তি খোঁজে।

দীর্ঘ ৯ বছর পর হঠাৎ আব্দুল গউস লোকালয়ে উপস্থিত। সবার মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য কোলোহল দেখা দিল। লোকেরা এসে তার খোঁজখবর নিচ্ছিল। কিন্তু মাস খানিক পর আবার আব্দুল গউস নিরুদ্দেশ। পরীদের সঙ্গে তার সমজাত্যের আকর্ষণ তাকে এবার পরীর দেশে এমনভাবে নিয়ে গেছে, যেভাবে তীর-বল্লমের আঘাতে প্রাণ উড়ে যায় দেহপিঞ্জর ছেড়ে।

নয় বছর জ্বিনপরীদের সঙ্গে থাকার ফলে আব্দুল গউসের স্বভাবে চরিত্রে জ্বিনপরীর স্বভাব সঞ্চারিত হয়েছিল। আসলে আগে থেকেই তার স্বভাবে জিনপরীর সমজাত বিদ্যমান ছিল। ফলে মানুষের সমাজে থাকার ধৈর্য তার স্বভাবে সয়নি। সমজাতের আকর্ষণ তাকে ছিনিয়ে নেয় সমজাতের কাছে। এখানে মূল শব্দ জিনসিয়্যত বা সিনখিয়্যত। বাংলা অর্থ সমজাত, সহজাত। সমজাতের আকর্ষণ মসনবিতে মওলানা রুমির অন্যতম জীবনদর্শন। এর মূলকথা, ভালোরা আকৃষ্ট হয় ভালোদের দিকে আর মন্দরা মন্দদের দিকে। এই আকৃষ্ট হওয়া সহজাত বা স্বভাবগত। মওলানা বলেন,

নারিয়ান মর নারিয়ান রা জাযেবান্দ

নুরিয়ান মর নুরিয়ান রা তালেবান্দ

নারিরা নারিদেরকেই সন্ধান করে বেড়ায়

নুরীরা ঘুরে নুরীদের আকর্ষণ আওতায়।

নুর মানে আলো-জ্যোতি। নুরী রূপকার্থে ফেরেশতা স্বভাবের লোক। আর নার মানে আগুন। নারী অর্থ আগ্নেয়, আগুনের তৈরি, রূপকার্থে শয়তান স্বভাবের। অর্থাৎ ফেরেশতা স্বভাবের লোকেরা সহজাতভাবে ফেরেশতা স্বভাবের লোকদের প্রতি আকৃষ্ট হয়; আর যারা শয়তানি স্বভাবের তারা শয়তান চরিত্রের লোকদের মাঝে মনের মিল খুঁজে পায়। তালেব মানে সন্ধানী আর জাযেব মানে আকর্ষণকারী। এই সমজাত আকর্ষণ ফারসি সাহিত্যের অন্যতম প্রতিপাদ্য। খসরু শিরীন প্রণেতা ফারসি সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল নিজামি গাঞ্জাবির উক্তিটি প্রবাদে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন,

কুনাদ বা জিন্সে খোদ হার জিন্স পরওয়াজ

কবুতর বা কবুতর বাজ বা বাজ

প্রত্যেক জিনিস তার সমজাতের জিনিসের সাথে ওড়ে

কবুতর কবুতরের সাথে, বাজ বাজপাখির সমবিভ্যহারে।

(খামসায়ে নিজামি, খসরু শিরীন, খসরু শাপুরকে শিরীনের সন্ধানে পাঠানো অধ্যায়) মওলানা রুমি (রহ.) এই জীবনদর্শনকে সম্প্রসারিত করেছেন মসনবির বিভিন্ন গল্পে বিশেষত আব্দুল গউস এর গল্পের আদলে। তিনি বলেন,

চোন বেহেশতি জিনসে জান্নাত আমদাস্ত

যারা বেহেশতি বেহেশতের সাথে তাদের সমজাত

সমজাতের আকর্ষণেই তারা হয় আল্লাহর অনুগত।

মওলানা বলছেন, যারা আল্লাহর অনুগত বান্দা, ইবাদত বন্দেগির দিকে যাদের মনের ঝোঁক তারা বেহেশতি সমজাতের। বেহেশতি সমজাতই তাদের আকৃষ্ট করে আল্লাহর ইবাদতের দিকে, বেহেশতে যাওয়ার কাজকর্ম আমলের দিকে। কাজেই তুমি তোমার মনের খবর নিয়ে দেখ।

ন নবি ফারমুদ জুদ ও মাহমাদাহ

শাখে জান্নাত দান বে দুনিয়া আমাদা

নবী কি বলেননি দানশীলতা ও প্রশংসিত চরিত্র

বেহেশতের শাখা-প্রশাখা দুনিয়ার দিকে প্রসারিত।

এক হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, বেহেশতের যে চিরসুখের বৃক্ষরাজি তার শাখা-প্রশাখা দুনিয়ার দিকেও প্রসারিত আছে। সেই শাখা-প্রশাখা হলো দানশীলতা আর মানবীয় চরিত্রের সব সুন্দর সুষমা। এই সূত্র অনুযায়ী যত ভালোবাসা মায়ামমতার বিস্তার দেখতে পাবে তা আসলে আল্লাহর ভালোবাসার বৃক্ষের ডালপালা। আর যত রাগ গোস্বার বিস্তার দেখবে তাও আল্লাহর কাহহারিয়াত ক্রোধ, কঠোরতা ও দমনকারী গুণের সম্প্রসারিত রূপ। মওলানা বলেন, এই যে জিনসিয়্যতে সহজাতের কথা বললাম তার স্বরূপ কী।

চিসত জিনসিয়্যত ইউকি নুএ নজর

কে বেদান য়াবন্দ রাহ দর হামদিগর

সমজাত কী? সে তো এক ধরনের দৃষ্টিকোণ

তোমাকে দেয়া হলে পাবে তুমি অন্য ভুবন।

সমজাত বলতে সেই সহজাত স্বভাব বুঝায়, যে স্বভাবটি হয়তো অন্যের আছে, তা যদি তোমার মধ্যে দেওয়া হয় তুমিও একই স্বভাবের হয়ে যাবে। অন্যকথায় তোমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাও তোমার জীবনও বদলে যাবে। এই যে সমজাতের পরস্পরের দিকে আকর্ষণের কথা বলা হলো, তা কি দৈহিক আকর্ষণ। না দৈহিক বা বাহ্যিক মিল ও আকর্ষণ নয়; বরং অন্তর্গত অবস্থা ও আকর্ষণই মানুষের চরিত্র ও ব্যবহার, স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ যে কাজ করে বা তার আচরণে যা প্রকাশ পায় তা আসলে তার হাত-পায়ের কর্ম নয়; বরং তার চিন্তাশক্তি তাকে যে নির্দেশনা দেয় সেটিই আচরণ ও কর্মরূপে হাত পায়ের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। কাজেই তোমার আচরণ ও স্বভাব নিয়ন্ত্রিত হয় অলক্ষ্য হতে। উদাহরণ স্বরূপ-

চোন নাহাদ দর তো সেফাতে জিবরাইল

হামচো ফরখি বর হাওয়া জুয়ি সবিল

যদি তোমার মাঝে থাকে জিবরাইলের গুণ-স্বভাব

পাখির ছানার মতো ডানা ঝাপটাবে আকাশে ওড়ার।

পাখির ছানা আকাশে উড়াল দেওয়ার জন্য ফড়ফড় করে। ফেরেশতার স্বভাব তোমার মধ্যে থাকলে তুমিও মনের দিক থেকে আকাশে ওড়ার স্বপ্নে বিভোর থাকবে। অপেক্ষার প্রহর গুণবে কখন মাটির সাথে সম্পর্কহীন হয়ে আকাশের প্রেমে আকুল হবে। আর যদি তোমার মধ্যে দেওয়া হয় গাধার স্বভাব, তোমার শত ডানা থাকলেও খোয়াড়ের ওপর ঝাপ দিয়ে পড়বে। দেখ, ইঁদুর যে ঘৃণ্য স্বভাবের তা তার বাহ্যিক আকৃতির কারণে নয়; বরং তার মধ্যে যে নোংরা স্বভাব আছে সে জন্যই সে তুচ্ছ, নিগৃহীত ঘৃণ্যরূপে। এ কারণে, যদি সাদা বাজপাখির মধ্যেও ইঁদুরের স্বভাবথাকে, সে বাজপাখি ইঁদুরের চেয়ে নিকৃষ্ট, পশুসমাজের লজ্জার কারণ হবে। তুমি হয়তো দুটি জিনিসকে বাইরে দেখবে একই রকম, কিন্তু ভেতরে স্বভাবের দিক দিয়ে দেখবে ভিন্নরকম। একই রূপ একই চেহারা, অথচ একজন মূসা, আরশের দিকে তার নজর। আরেকজন ফেরাউন, পশুর চেয়েও অধম যার অন্তর। বলতে পার, এখন আমার করণীয় কী।

দরপেয়ে খু বাশ ও বা খুশখু নশিন

খু পজিরিয় রওগনে গুল রা বেবিন

সুন্দর স্বভাব সন্ধান কর মিশ সুন্দর চরিত্রবানের সঙ্গে

দেখ গোলাপের তেল কীভাবে খুশবু-স্বভাব গ্রহণ করে।

মওলানা এখানে গল্পের মূল শিক্ষা তুলে ধরে বলছেন, তুমিও সুন্দর স্বভাবের অধিকারী হও। প্রশ্ন আসতে পারে মানুষের স্বভাব কি বদলায়। হ্যাঁ, বদলায়। কীভাবে বদলায় সুন্দর চরিত্রের মানুষদের সাথে যদি উঠাবসা কর এবং তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের মনোভাব তোমার থাকে, তাহলে তোমার স্বভাবও সুন্দর খুশবুদার হয়ে যাবে। যেমন সাহচর্যের প্রভাবে তিলের তেল বদলে যায় অতি উন্নত গোলাপ তেলে।

তিলের তেল কীভাবে উন্নত গোলাপ তেলে পরিণত হয় তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন করিম জামানি। বলেছেন, বোতলের মধ্যে তিলের তেল নেওয়া হয়, সেই তেলে কতক গোলাপের পাপড়ি ফেলে দেয়া হয়। বোতলকে দিনের রৌদ্রের তাপে রাখা হয়। কিছুদিন পর গোলাপের পাপড়ি বোতলের ভেতর রঙ বদলে সাদা হয়ে যায়। তারপর তিলের তেল ছেঁকে পাপড়িগুলো বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। আবার নতুন পাপড়ি দেওয়া হয়। একই নিয়মে রৌদ্রতাপে শুকানো হয়। তিলের তখন গোলাপের সুবাস চুষে নিতে থাকে। এভাবে সাতবার পাপড়ি বদলানোর পর তিলের তেল অতি উন্নত গোলাপ তেলে পরিণত হয়। যার বৈশিষ্ট্য হয় শরীরে শক্তি সঞ্চারক, মাথাব্যথার উপশম, অনিদ্রা দূরকারী, পরিপাকতন্ত্রের সাহায্যকারী আরও আরও উপকার সাধনকারী।

হে সাধক! তুমিও নেককার লোকদের সাহচর্যে নেককার হওয়ার সুন্দর স্বভাবে সজ্জিত হওয়ার চেষ্টা কর। দেখ, কারও সাহচর্যের গুরুত্ব কতখানি অনুধাবন কর, বলা হয়েছে বাড়ি করার আগে তোমার প্রতিবেশী কে হবে তা আগে দেখ। কেননা, প্রতিবেশী যদি খারাপ স্বভাবের হয় তাহলে তোমার বাড়ি যতই জৌঁলুসপূর্ণ হোক সেখানে শান্তি নেই।

এখন তুমি নিজেকে পরীক্ষা করে দেখতে পার, কোনো সমজাতের স্বভাব দিয়ে তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমার সমজাত কি দ্বীনের স্বভাবে সজ্জিত, নাকি কুফরির নর্দমার দিকে আকৃষ্ট। তোমার মনের টান যদি হয় হামানের দিকে, তাহলে তুমি হামান। আর যদি মুসার দিকে হয় তোমার আকর্ষণ, তাহলে তুমি মুসার মতো সুবহানি স্বভাবের। যদি তোমার মধ্যে মুসার প্রতি আকর্ষণ আর মুসার প্রতিদ্বন্দ্বী হামানের প্রতিও মনের ঝোঁক আকর্ষণ অনুভব কর, তাহলে বুঝে নাও যে, তুমি নফস আর আকল (জ্ঞানবুদ্ধি) এর মিশ্র বিক্রিয়ায় আক্রান্ত। যদি লক্ষ্য কর, দেখবে তোমার ভেতরে মুসার স্বভাব ও হামানের স্বভাবে যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে তুমি একটি পক্ষ নাও, যাতে তোমার আত্মিক শক্তি বিজয়ী হয়, পরাজিত করে রং চাকচিক্যকে। মনে রাখবে-

কাফেরান চোন জিনসে সিজ্জিন আমদন্দ

সিজনে দুনিয়া খোশ আয়িন অমাদান্দ

কাফেররা সৃষ্ট সিজ্জিন (কারাগার) দোজখের স্বভাব দিয়ে

তাদের চোখে দুনিয়ার কারাগারই সুন্দর রংরূপে জৌলুসে।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ২৯৭৪-৩০১৩)।

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত