
নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় দীর্ঘ তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকার পর সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) থেকে তা আবার শুরু হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে উপকূল জুড়ে সুন্দরবন কেন্দ্রিক কর্মজীবীদের মাঝে বেড়েছে সব ধরনের কর্মচঞ্চলতা। একই সঙ্গে পর্যটকদের জন্যও উন্মুক্ত হচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্যের এই অরণ্য সুন্দরবন। পর্যটক ও প্রকৃতি প্রেমীরাও প্রস্তুত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন দেখতে যাওয়ার জন্য।
ফলে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা উপকূলে এখন ব্যস্ত সময় পার করছে বনজীবী ও পর্যটন নির্ভর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতিমধ্যে নৌকা-ট্রলারের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
অভাব-অনটনে পড়ে থাকা বনজীবীরা কষ্ট ভুলে আবারও নতুন উদ্যমে রুজির সন্ধানে ফিরতে চান সুন্দরবনে। টানা তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকার পর সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে বনজীবী ও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে সুন্দরবন। এতে স্বস্তি ফিরেছে এসব পেশায় যুক্ত সাধারণ মানুষের। বর্তমানে সুন্দরবন উপকূলের মানুষের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
সুন্দরবনের জলভাগে নানা প্রজাতির মাছ, চিংড়ি এবং কাঁকড়া পাওয়া যায়। জুন থেকে আগস্ট মাস প্রজনন মৌসুম হওয়ায় মাছের ডিম ছাড়ার সময় থাকে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার; যা পুরো সুন্দরবনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ শতাংশ।
সুন্দরবনের জলভাগে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশির ভাগ মাছ ডিম ছাড়ে। এ কারণে গত ১ জুন থেকে তিন মাসের জন্য জেলে ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বন বিভাগ। সোমবার থেকে সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে।
বনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেষ মুহূর্তের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন তারা। অনেকেই ব্যস্ত সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতিপত্র নেওয়ার জন্য।
সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল একাধিক জেলে জানান, এ বনের ১০০ ভাগের ৫২ ভাগই অভয়ারণ্য। খোলা আছে মাত্র ৪৮ ভাগ। বাকিটা উন্মুক্ত করতে হবে। কেননা, বনের উন্মুক্ত জায়গাগুলোতেই দুই থেকে তিন হাজার জেলে-বাওয়ালি মাছ ও কাঁকড়া আহরণ করে। যে কারণে পর্যাপ্ত মাছ বা কাঁকড়া পান না কেউ।
তারা আরও জানান, টানা তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধ থাকায় অভয়ারণ্যে কিছু অসাধু চক্র বিষ দিয়ে মাছ এবং ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। কিন্তু বনবিভাগ সেদিকে ঠিকমতো নজর দিতে পারছে না।
বুড়িগোয়ালিনীর ট্রলার মালিক নুর ইসলাম জানান, টানা তিন মাস তার ট্রলারটি পড়ে থাকার কারণে অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। এজন্য সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে সেটি মেরামত করছেন।
তিনি বলেন, এই তিন মাস সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা না দিলে আমাদের ঋণের বোঝা টানতে হতো না। এখন বনে যাওয়ার পর আয় করে তা দিয়ে সমিতির ঋণ শোধ করবেন। ওই টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধের পর পরিবার চালাতে বেশ কষ্ট হবে।
দাতিনখালির জেলে জাহাঙ্গীর সানা জানান, সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া আহরণ বন্ধ থাকায় এতদিন বেশ কষ্টে কেটেছে। সুদ করে টাকা নিয়ে সংসার চালাতে হয়েছে, যা এখন শোধ করতে হবে।
দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার চাঁদনীমুখা গ্রামের বনজীবী ইউনুস বলেন, দীর্ঘ তিন মাস সুন্দরবন বন্ধ থাকার কারণে খেয়ে না খেয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে গেছি। সুন্দরবন খুলে দিয়েছে। এখন অভাব-অনটন কিছুটা হলেও কমবে। বনজীবী খানজাহান আলী বলেন, সবার আগে পাস নিতে এসেছি। দীর্ঘ তিন মাস সুন্দরবন বন্ধ ছিল। অনুমতি নিয়ে আগে যেতে পারলে বেশি মাছ পাব, এ জন্য আগে এসেছি।
অন্যদিকে পর্যটনশিল্পকে আকর্ষণীয় করে তুলতে ইতিমধ্যে পর্যটনসংশ্লিষ্টরা নতুন নতুন প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। ট্রলারগুলোকে নতুন নতুন রঙে সাজিয়ে তুলেছেন অনেকেই। পর্যটকদের সুন্দরবন আকৃষ্ট করার জন্যই এমন সুসজ্জা বলে জানিয়েছেন ট্রলার মালিকরা।
শ্যামনগর নীলডুমুর ঘাটের পর্যটকবাহী ট্রলার মালিক জয়নাল আবেদীন ও রিপন হোসেন বলেন, তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় জেলে বাওয়ালি পর্যটক কেউ-ই সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারেননি। জেলে বাওয়ালিদের সঙ্গে ট্রলার মালিকসহ সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদেরও দুর্দিনে কেটেছে এ সময়। তিনি আরো জানান, সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে শতাধিক পর্যটন ট্রলার আছে। আশা করছি পর্যটকদের সেবার কমতি হবে না।
বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, জেলে, বাওয়ালি ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশের জন্য এরই মধ্যে এ বনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশনে মোট ২ হাজার ৯৭০টি পাস নবায়ন করা হয়েছে। তারা সরকারি রাজস্ব দিয়ে বনে প্রবেশ করতে পারবেন।
সুন্দরবন ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি খোদা বক্স গাজী বলেন, পর্যটকের ওপর নির্ভর করে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় পাঁচ শতাধিক ট্রলার চলে। সুন্দরবনে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখার পাশাপাশি পর্যটক ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় ট্রলার চালক ও শ্রমিকরা বেকার জীবনযাপন করেন। তাদের সংসার চলে খুব কষ্টে ধারদেনা করে।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারি বন সংরক্ষক (এসিএফ) ফজলুর রহমান বলেন, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা, জীবজন্তু ও মাছের প্রজনন বাড়ানোর জন্য ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে নদ-নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরা ও পর্যটক প্রবেশেরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) থেকে শুরু হচ্ছে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি।
ইতিমধ্যে বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ অফিসের সন্নিকটের অফিস কলাগাছিয়াকে সাজানো হয়েছে নানান রূপে। করমজল থেকে সংযুক্ত হয়েছে তিনটি কুমির। সংস্কার হয়েছে ফুট-ট্রেলসহ পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর রাস্তা।
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনের পর্যটনশিল্পকে আরো আকর্ষণীয় করতে আমরা সজাগ আছি। এ জন্য দর্শনার্থীদের ভ্রমণকে সুন্দর ও সার্থক করতে আমরা কাজ করছি। এ ছাড়া সুন্দরবনের পর্যটন স্পটগুলোতে আরো নতুন কিছু সংযোজন করার কথাও জানান ওই কর্মকর্তা। জেলে বাওয়ালিদের সুন্দরবন কেন্দ্রিক সকল ধরনের সহযোগিতা ও নিরাপত্তা দিবে বনবিভাগ।
উল্লেখ্য, সুন্দরবনের পরিবেশ ও মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্লানিংয়ের সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের সব নদী-খালে মাছ আহরণ বন্ধ থাকে। তবে চলতি বছর এই সময় একমাস বাড়িয়ে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করে বন মন্ত্রণালয়। এই তিন মাস মাছ আহরণ বন্ধের পাশাপাশি পর্যটক প্রবেশও নিষিদ্ধ করা হয়। সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় জেলেরা ছাড়াও এই সুবিধা পাবেন ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা।