
মিশ্র ফল বাগানে গাছের ফাঁকে নামমাত্র শ্রমে ও অল্প খরচে বস্তায় হলুদ চাষ করে বাড়তি আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন শেরপুরের নকলা উপজেলার অনেকে। এমন একজন চাষি হলেন, উপজেলার বানেশ্বরদী ইউনিয়নের বানেশ্বরদী দক্ষিণপাড়া এলাকার মোস্তাক আনোয়ার রাকিব।
রাকিব তার বাড়ির পাশের মিশ্র ফল বাগানে গাছের ফাঁকে ১ হাজার ৪০০ বস্তায় হলুদ চাষ করে এলাকাবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। গাছের ফাঁকে অন্যকিছু আবাদ করা সম্ভব না হলেও, বস্তায় হলুদ চাষের মাধ্যমে বাড়তি আয়ের পথ খুঁজে পাওয়ায় এই মশলা জাতীয় বর্ষজীবী ফসল চাষে ঝুঁকছেন কৃষক।
আগে যেকোনো গাছের বাগানে আগাছা জন্মাতো, অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখা হতো, সেখানে এখন বস্তায় হলুদ চাষ করা হচ্ছে। আবাদি জমিতে হলুদ চাষ করলে তাতে মাটি বাহিত রোগের কারণে আশানুরূপ ফলন পওয়া যেতো না। তাই বস্তায় চাষ পদ্ধতি দিন দিন নকলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
রাকিব জানান, তার মিশ্র ফল বাগানের গাছের ফাঁকে ১ হাজার ৪০০ বস্তায় হলুদ রোপণ করতে ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে, প্রতিটি বস্তার দাম গড়ে ৯ টাকা, এক হাজার টাকা করে প্রতি মণ ৬০ কেজি বীজ হলুদ, এক হাজার টাকার ছাই, ২ হাজার টাকার গোবর, মাটি ৩ ট্রাক, বিভিন্ন রাসায়নিক সার ২ হাজার ৫০০ টাকার ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা উল্লেখ করার মতো। এক বছর মেয়াদী এই ফসলে দ্বিগুণ লাভ হবে বলে তিনি জানান।
তিনি আরো জানান, বহুবর্ষজীবী গাছের নতুন কোনো বাগান করলে, গাছ বড় হতে কয়েক বছর সময় লাগে। এতে গাছের ফাঁকে বেশ জায়গা পতিত থাকে। এসব পতিত জমিতে বিভিন্ন শাক-সবজি, আদা, হলুদ, মরিচসহ স্বল্পকালীন বিভিন্ন ফসল আবাদ করা যায়। এতে গাছের বাগানের কোনো ক্ষতি হয় না, বরং গাছের ফাঁকে শাক-সবজিসহ স্বল্পকালীন বিভিন্ন ফসল আবাদ করলে বাড়তি আয় পাওয়া যায়। এছাড়া গাছের ফাঁকের পতিত জমিতে স্বল্পকালীন আবাদ করায় গাছের জন্য বাড়তি কোনো সেবাযত্ন করতে হয় না।
মোস্তাক আনোয়ার রাকিবের বাগানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তার মিশ্র ফল বাগানে আম, পেয়ারা, লটকন, মালটা ও পেঁপেসহ সবজির মধ্যে বেগুন, মরিচ, কুমড়ার আবাদ করেছেন। এছাড়া বাগানের বাইরে সুপাড়ি ও লেবু গাছ রোপণ করেছেন। আর এসব গাছের ফাঁকে ১ হাজার ৪০০ বস্তায় হলুদ রোপণ করেছেন। প্রতিটি বস্তার হলুদ গাছ পাতাসহ ৫ ফুট থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়েছে। এখন আবাদের মাঝামাঝি সময় হলেও হলুদের চাপে মাটি ফাটা শুরু হয়েছে। এতে স্থানীয় কৃষকরা মনে করছেন ব্যাপক ফলন হবে। রাকিব আশা করছেন প্রতি বস্তায় দেড় কেজি থেকে ২ কেজি করে হলুদ উৎপাদন হবে। তার ১ হাজার ৪০০ বস্তা হলুদ থেকে সব খরচ বাদে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা লাভ থাকবে বলে আশা করছেন; যা পুরোটাই বাড়তি আয়।
স্থানীয় অনেক কৃষক জানান, গাছের বাগানে সাথী ফসল হিসেবে হলুদের আবাদ বেশি হয়। আর তাই তো বোনাস ফসল হিসেবে কৃষকরা সাথী ফসল হিসেবে হলুদ চাষ করেন। কয়েক বছর ধরে উপজেলার চন্দ্রকোনা, চরঅষ্টধর, পাঠাকাটা, বানেশ্বরদী ও গৌড়দ্বার ইউনিয়নসহ বেশ কিছু এলাকায় মিশ্র গাছের বাগানে হলুদ চাষ করা হচ্ছে। তবে এবার কৃষকের আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায় হলুদের আবাদ কয়েকগুণ বেড়েছে। ফলে চলতি মৌসুমে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে অর্জন বেড়েছে।
ভূরদী খন্দকার পাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলহাজ্জ মো. ছায়েদুল হক জানান, তাদের গাছের বাগানের ফাঁকের জায়গা পতিত ফেলে রাখা হতো। কৃষি বিভাগের পরামর্শে কয়েক বছর ধরে গাছের ফাঁকে বস্তায় আদা ও হলুদ চাষ শুরু করেছেন। প্রথমে নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য চাষ করলেও এখন তা বাণিজ্যিকভাবে করা হচ্ছে। সামান্য পরিশ্রম ও অল্প খরচে অধিক লাভ পাওয়ায় যেকোন বাগানে হলুদ চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় বস্তায় হলুদ চাষে ঝুঁকছেন কৃষক। ফলে কৃষকের বাড়ির আঙিনায়, পুকুর পাড়ে, রাস্তার দুই পাশে ও পরিত্যক্ত পতিত জমিতে এখন ফসল ফলানোর ভূমি হয়ে উঠেছে। বাড়ছে কৃষি উৎপাদন, সমৃদ্ধ হচ্ছে কৃষি অর্থনীতি; এমনটাই মনে করছেন তিনি।
কৃষকরা জানান, বাড়ির আঙিনায়, সুপারি বা যেকোন বর্ষজীবী গাছের বাগানে, পুকুর পাড়ে, আলোছায়া ঘেরা উঁচু জমিতে, ফলের বা কাঠের বাগানের নিচে বা পতিত জমিতে বস্তায় মাটি ভরে নামমাত্র খরচে হলুদ চাষে কয়েকগুণ বেশি লাভ পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে চাষ করেল আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না, অনাবাদি বা পতিত জায়গায় সহজে হলুদ চাষ করা সম্ভব।
তারা আরো জানান, প্রতি কাঠা (৫ শতাংশ) জমিতে ২০ কেজি থেকে ২২ কেজি বীজ হলুদ লাগে; এতে উৎপাদন হয় ১০ মণ থেকে ১২ মণ। মাটির ধরন, উৎপাদন, বাজার মূল্য ও চাহিদা বিবেচনায় হলুদ চাষে লাভ বেশি। বর্তমান বাজার দাম অনুযায়ী প্রতি কাঠাতে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা লাভ থাকে; যা অন্য কোনো কৃষিপণ্যে সম্ভব নয়। হলুদ আবাদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের মাঝে প্রণোদনা বৃদ্ধি ও প্রদর্শনী বরাদ্দ বাড়ালে এ উপজেলাসহ দেশব্যাপী হলুদ উৎপাদনে নজির সৃষ্টির আশা ব্যক্ত করেন।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় ৩টি প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়। হলুদ চাষের জন্য ৩টি প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি প্রদর্শনীর জন্য কৃষককে ২০০ কেজি করে হলুদ বীজ প্রদান করা হয়েছে। এতে মোট ৬০০ কেজি হলুদ বীজ বিতরণ করা হয়। সব মিলিয়ে উপজেলায় ৭০ হেক্টর জমিতে হলুদ চাষ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মোরসালীন মেহেদী। তবে উপজেলার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৭০ হেক্টর থেকে ৭৫ হেক্টর জমিতে হলুদ চাষ করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, নকলায় স্থানীয় সুন্দরী জাতের হলুদ বেশি আবাদ হয়েছে। মাটির ধরন ও সেবার উপর ভিত্তি করে হেক্টর প্রতি ১৮ মেট্রিকটন থেকে ২০ মেট্রিক টন হলুদ উৎপাদন হয়। এই উপজেলার মাটি হলুদ চাষের জন্য উপযোগী। হলুদ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারিভাবে কৃষি প্রণোদনা বা প্রদর্শনী বরাদ্দের মাধ্যমে এবং উন্নত জাতের বীজ বিতরণের মাধ্যমে আগামীতে হলুদ আবাদ ও চাষির সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব। বস্তায় ও পতিত জমিতে হলুদ চাষ করে যে কেউ লাভবান হতে পারেন বলে মনে করেন কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী।