ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডে বদলে যাচ্ছে চরবাসীর আর্থ-সামাজিক জীবন

আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডে বদলে যাচ্ছে চরবাসীর আর্থ-সামাজিক জীবন

১৬টি নদ-নদী বেষ্টিত কুড়িগ্রাম জেলায় রয়েছে প্রায় সাড়ে চার শতাধিক চর। এইসব চরে বসবাস করে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য পরিবার। প্রতিবছরই বন্যা ও নদীভাঙনের কবলে পড়ে এইসব পরিবার। বিনষ্ট হয় চরের ফসল এবং পরিবারগুলো পড়ে যায় চরম সংকটে। হয়ে যায় দিশেহারা।

সৃষ্ট এ পরিস্থিতিতে দুর্দশাগ্রস্ত ৮৪০টি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার এবং একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ, বাংলাদেশ। দুর্যোগকালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার পাশাপাশি পারিবারিকভাবে আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। এ সহযোগিতায় এসব পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। সেই সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে তাদের জীবনমান।

সংস্থাটি এ বছর জেলার চিলমারী, রৌমারী ও সদর উপজেলায় ২৮টি চরের ৮৪০টি দরিদ্র পরিবারকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে উন্নয়নমুখী হতে সহযোগিতা করছে। প্রশিক্ষণসহ পরিবারগুলোকে শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে শাকসবজির বীজ দেওয়া ছাড়াও তাদের মাঝে ভেড়া বিতরণ করা হয়েছে।

এছাড়াও ফ্রেন্ডশিপ বিভিন্ন দুর্যোগে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বন্যাকালীন সময়েও যেন সবজি উৎপাদন অব্যাহত থাকে, সেজন্য কমিউনিটি ভিত্তিক সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে সংস্থাটি। বস্তায় আদা চাষে উৎসাহিত করায় গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে ইদানীং বস্তায় আদা চাষ হচ্ছে।

সবজি উৎপাদনে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন এবং তা ব্যবহারে সহায়তা প্রদান করছে। পরিবারগুলোর বন্ধন অটুট রাখার জন্য পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ ও আইনগত বিষয়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।

গতকাল কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকায় অবস্থিত চর যাত্রাপুর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, এই গ্রামের বন্যাকবলিত এবং নদীভাঙনের শিকার ৩০টি পরিবারকে পারিবারিক আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ড ছাড়াও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে যুক্ত করা হয়েছে।

এই গ্রামের বাসিন্দা আকলিমা জানান, ফ্রেন্ডশিপের ট্রানজিশনাল ফান্ড প্রকল্প থেকে তাকে ৪ হাজার ১০০ টাকা দিয়ে একটি ভেড়া দেওয়া হয়েছে এবং সেটি থেকে ৪টি বাচ্চা হয়েছে। এখন তার ৬টি ভেড়া, যার বাজারমূল্য প্রায় ৪২ হাজার টাকা।

একই গ্রামের তাজমা বেগম বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে শাকসবজি উৎপাদনের প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর নিজের বসতবাড়িতে সবজি উৎপাদন করে এ বছর ২০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছেন। এতে তিনি সংসারের ব্যয়ভার বহন করে কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতে পেরেছেন। স্বামীর একার আয়ের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না।

চর যাত্রাপুর গ্রামের রাহেনা বলেন, প্রকল্প থেকে কেঁচো সার তৈরির প্রশিক্ষণ পেয়ে বসতবাড়িতে কেঁচো সার উৎপাদন করছেন এবং প্রতিমাসে প্রায় ১ হাজার ২০০ টাকার কেঁচো সার বিক্রি করছেন।

খাদিজা বেগম জানান, তিনি ফ্রেন্ডশিপের সহায়তায় ১০০টি বস্তায় আদার চাষ করেছেন এবং প্রতি বস্তায় ১ থেকে দেড় কেজি আদা পাবেন বলে আশা করছেন। এ গ্রামের আরও অনেকে বস্তায় আদা চাষ, সবজি ও ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন এবং ভেড়া পালন করে পরিবারের আয়বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন।

এই গ্রামের লেবু মিয়া জানান, তাদেরকে সুশাসন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা এখন পারিবারিক নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, তালাকপ্রাপ্তি, বহুবিবাহ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সংবিধান ও সংসদ সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন। এখন কোনো আইনি পরামর্শ প্রয়োজন হলে তারা ফ্রেন্ডশিপের সহায়তা গ্রহণ করেন। সংস্থাটি বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ প্রদান অব্যাহত রেখেছে।

ঐ গ্রামের রবিউল ইসলাম, আম্বিয়া ও সুমি বেগম বলেন, আগে হাট থেকে রাসায়নিক সার কিনে আনতাম, এখন আমরা জৈব সার তৈরি করে ব্যবহার করি। ফেরোমন ফাঁদ দিয়ে পোকা মারছি, সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেতে বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করছি।

কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে ফ্রেন্ডশিপের ট্রানজিশনাল ফান্ড (এএসডি) প্রকল্পের রিজিওনাল ম্যানেজার কৃষিবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম মল্লিক জানান, ফ্রেন্ডশিপ লুক্সেমবার্গের সহায়তায় সদস্যদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুশাসন এবং স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়নে কুড়িগ্রাম সদর, চিলমারী এবং রৌমারী উপজেলার মোট ২৮টি চরে এ বছর ৮৪০ জন সদস্যকে উক্ত প্রকল্পের আওতায় সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, উক্ত প্রকল্পের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক উপকারভোগীদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ কারিগরি সহায়তা দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. হাবিবুর রহমান জানান, কুড়িগ্রাম সদর, চিলমারী এবং রৌমারী উপজেলায় ফ্রেন্ডশিপের ট্রানজিশনাল ফান্ড প্রকল্পের মাধ্যমে এ বছর ৮৪০টি পরিবারকে ভেড়া প্রদান করা হয়েছে এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ফলে পরিবারগুলো ভেড়া পালনের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে অধিক আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। প্রত্যেকটি ভেড়াকে টিকা ও কৃমিনাশক বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে।

চর এলাকা ভেড়া পালনের জন্য উপযুক্ত, তাই ভেড়া পালনের মাধ্যমে চরাঞ্চলের মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলা সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আর্থ-সামাজিক জীবন,বদলে যাচ্ছে চরবাসী,আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ড
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত