
লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলায় বৈধ ও অবৈধ মিলে অর্ধশতাধিকেরও বেশি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ইটভাটার জন্য ফসলি জমির প্রাণ হিসেবে পরিচিত উপরিভাগের মাটি বা ‘টপ সয়েল’ কাটার মহোৎসব চলছে। আমন ধান ঘরে তোলার পরপরই শুরু হয়েছে এই মাটি লুটের যজ্ঞ। বিভিন্ন গ্রাম থেকে উর্বর কৃষিজমি থেকে দেদারসে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্থানীয় ইটভাটাগুলোতে। এতে আশঙ্কাজনক হারে কমছে আবাদি জমি, নষ্ট হচ্ছে মাটির উর্বরতা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাস্তাঘাট। এছাড়া ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করলেও থামছে না ‘মাটিখেকো’ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য।
গত বছরের সরকারি তালিকা অনুযায়ী, লালমনিরহাটে নিবন্ধিত ইটভাটার সংখ্যা ২২টি। অথচ অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে আরো অন্তত ৩৪টি। প্রশাসনের অভিযানে মাঝেমধ্যে এসব ভাটা বন্ধ বা জরিমানা করা হলেও, নানা অজুহাতে কিছুদিন পরই তা পুনরায় চালু হয়। সম্প্রতি আদিতমারীতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই পরিচালিত ৪টি ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, হাইকোর্টেও নির্দেশনার ও জেলা প্রশাসকের আদেশ অনুযায়ী কৃষি জমিতে স্থাপিত এবং লাইসেন্সবিহীন ইটভাটার বিরুদ্ধে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানের সময় সাপ্টিবাড়ী ইউনিয়নের এল.এম.বি ব্রিকসকে ২ লাখ, ওয়ান স্টারকে ২ লাখ, সান টু ব্রিকসকে ১ লাখ ও জে আর ব্রিকসকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে আদায় করা হয়। এছাড়াও গত এক বছরে অন্তত ৫টি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া।
আদিতমারী উপজেলার সাপ্টিবাড়ী এলাকার কৃষক আলী আহমেদ জানান, আবাদি জমির পাশেই ভাটা তৈরি হওয়ায় এবং পাশের জমির মালিকরা মাটি বিক্রি করে দেওয়ায় আমরা বিপাকে পড়েছি। পাশের জমি নিচু হয়ে যাওয়ায় আমার জমি উঁচু হয়ে আছে, ফলে জমিতে সেচের পানি (মটরের পানি) উঠছে না। তাই ক্ষতি হবে জেনেও বাধ্য হয়ে ভাটা কর্তৃপক্ষের কাছে মাটি বিক্রি করতে হচ্ছে।
একই পরিস্থিতির শিকার ওই উপজেলার ভাদাই ইউনিয়নের কৃষক রাশিদ মিয়া। তিনি বলেন, এখনও জমির ফসল ঘরে তুলতে পারিনি, অথচ পাশের জমির মাটি বিক্রি হয়ে গেছে। এখন আমি মাটি বিক্রি না করলে আমার জমি উঁচু হয়ে থাকবে, সেখানে আর ফসল হবে না। আবার মাটি কাটলে সেই জমিতে নতুন করে ফসল ফলাতেও অনেক কষ্ট হবে। আমরা চাই ইটভাটাগুলো যেন কৃষিজমি থেকে মাটি না কেনে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাটির উপরিভাগের ৮-১০ ইঞ্চি স্তর বা টপ সয়েলে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থ ও পুষ্টি উপাদান সবচেয়ে বেশি থাকে।
কৃষি বিভাগের মতে, এই স্তর কেটে নিলে জমির উর্বরতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায় এবং তা পুনরায় ফিরে আসতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। টপ সয়েল সরে গেলে মাটির নিচের শক্ত ও পাথুরে স্তর বেরিয়ে আসে, যেখানে পানি ধারণক্ষমতা থাকে না বললেই চলে। এতে জমি ধীরে ধীরে অনাবাদি হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। কৃষি প্রধান এই জেলায় আবাদি জমি কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কাও প্রবল হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, এসব ইটভাটা গড়ে ওঠায় আশঙ্কাজনক হারে কমছে আবাদি জমি, নষ্ট হচ্ছে মাটির উর্বরতা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিভিন্ন গ্রামের কাঁচা রাস্তাঘাট। পাকা রাস্তা থাকলেও ইটভাটার কারণে সেগুলোর অবস্থাও লক্কড়-ঝক্কর। উঠে যাচ্ছে কার্পেটিং আর সৃষ্টি হচ্ছে খানাখন্দ। এছাড়াও ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। তারা এসব থেকে পরিত্রাণের দাবি জানান।
লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন ইটভাটার মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ফসলি জমি রক্ষায় কেবল সচেতনতা নয়, প্রশাসনের কঠোর ও স্থায়ী পদক্ষেপও আরো জরুরি বলে মনে করছে স্থানীয় সচেতন মহল ও পরিবেশবিদগণ।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দারের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব না হলেও তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ইটভাটায় ফসলি জমির মাটি কাটা রোধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়াও লাইসেন্স ও পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকলে ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে এসব ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এবং জেলা জুড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলমান রয়েছে।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (কৃষিবিদ) মতিউর রহমান বলেন, সীমান্তবর্তী এই জেলার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস কৃষি। কিন্তু ইটভাটার কারণে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি যেন তারা টপ সয়েল বিক্রি না করেন। রাসায়নিক ও জৈব সারের সমন্বয়ে যে উর্বর স্তর তৈরি হয়, তা একবার নষ্ট হলে পূরণ করা কঠিন।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বালু ও সিমেন্ট দিয়ে পরিবেশবান্ধব ‘ইকো ব্রিকস’ বা ব্লক ইট তৈরি হচ্ছে। সমাজের মানুষকে এই ইটের প্রতি আগ্রহী হতে হবে। মাটির ইটের চাহিদা কমলে ফসলি জমির টপ সয়েল রক্ষা পাবে বলেও জানান জেলা কৃষি বিভাগের শীর্ষ এ কর্মকর্তা।