ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কক্সবাজার শত্রুমুক্ত দিবস ১২ ডিসেম্বর

কক্সবাজার শত্রুমুক্ত দিবস ১২ ডিসেম্বর

আগামীকাল ১২ ডিসেম্বর, কক্সবাজার শত্রুমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে কক্সবাজার শহরের পাবলিক লাইব্রেরি শহীদ দৌলত ময়দানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে কক্সবাজারকে শক্রমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল।

এ সময় চারটি গাড়িযোগে স্লোগান দিয়ে কক্সবাজার শহরে পৌঁছান ক্যাপ্টেন আবদুস ছোবহানসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা। শহরের ঐতিহাসিক পাবলিক লাইব্রেরির শহীদ দৌলত ময়দানে সকাল ১০টায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং শোডাউনের পর কক্সবাজারকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করে বক্তব্য দেন ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুস ছোবহান।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কক্সবাজার বান্দরবান জেলার অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন আব্দুস ছোবহান। পরবর্তীতে তার লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে কক্সবাজার-বান্দরবান’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমরা কক্সবাজার শহর দখল করার উদ্দেশ্যে চারটি বাসে করে পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্প হতে সকাল ১০টায় যাত্রা শুরু করি। রেডক্রস কর্মকর্তা প্রদত্ত সাদা জিপ, কপিল উদ্দিন চৌধুরী (রত্নাপালং) ও জনাব জিয়াউদ্দিন চৌধুরী (রত্নাপালং) আমাদের চারটি বাস জোগাড় করে দেন। আমাদের যাত্রাপথে কোনো কোনো স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা ওত পেতে থাকতে পারে এবং অতর্কিত হামলা করতে পারে আশঙ্কা করে অস্ত্রের নল গাড়ির বাহিরের দিকে রেখে সামনে এগোতে থাকি। সেই দিন ছিল মরিচ্যা বাজারের সাপ্তাহিক হাটবার। লোকে লোকারণ্য। আমরা যখন কোটবাজার ও মরিচ্যা বাজারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন রাস্তার দু-পাশে হাজার হাজার লোক দণ্ডায়মান হয়ে দুই হাত ওপরে তুলে আমাদের স্বাগত জানায়। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আমরা বাধাহীনভাবে লিংক রোড পর্যন্ত পৌঁছি। শুনলাম লিংক রোডের দক্ষিণে পাহাড়ে পাকহানাদারবাহিনী অবস্থান করছে। রেকি করে দেখলাম তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। অতঃপর হাশেমিয়া মাদ্রাসা পর্যন্ত যাবার পর আমার সহযোদ্ধাদের ৪টি গ্রুপে বিভক্ত করি। যাতে কক্সবাজার এলাকা সহজে ঘেরাও করা সম্ভব হয়। গ্রুপগুলোর অবস্থান হচ্ছে যথাক্রমে-১ম গ্রুপ: (আমি নিজে) সোজা রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত। ২য় গ্রুপ: হাশেমিয়া মাদ্রাসার পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে দক্ষিণে কিছুদূর গিয়ে পশ্চিম দিকের রাডার স্টেশন পর্যন্ত। ৩য় গ্রুপ: হাশেমিয়া মাদ্রাসা থেকে কিছুদূর পশ্চিমে গিয়ে দক্ষিণে কক্সবাজার রাডার স্টেশন পর্যন্ত। ৪র্থ গ্রুপ: হাশেমিয়া মাদ্রাসা থেকে সোজাসুজি উত্তর দিকে কিছুদূর গিয়ে বাঁকখালীর পাশ দিয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত।

সংবাদ শোনার সাথে সাথে বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো হাজার হাজার মুক্তিকামী জনতা পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে উপস্থিত হয়। এ যেন মানুষেরই সমুদ্র। তাদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হলো। স্বজন হারানোর ব্যথা প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। আমি কাকে রেখে কার কথা শুনবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাদের সান্ত্বনা দেবার ভাষাও আমার জানা নেই। শুধু স্বাধীন হওয়ার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিলাম। অতঃপর নূর হোটেলের সামনে একটি লম্বা কাঠ দিয়ে আমাকে জিপের ওপর দাঁড় করানো হলো, জনতার উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য। তাৎক্ষণিকভাবে কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবু যতটুকু পেরেছি তাদের সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছি।

ওই দিন তার দেওয়া বক্তব্যের একটি অংশে তিনি বলেছিলেন উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, ‘আপনারা যাদের হারিয়েছেন তাদের জন্য মন খারাপ করবেন না। বরং তাদের মৃত্যু নিয়ে গর্ববোধ করুন। মনে রাখবেন তারা স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছেন। তারা চির অমর, এই সেই কক্সবাজার যেখানে ছাত্রনেতা সুভাসকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে পাষণ্ডরা। এই সেই কক্সবাজার, যেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ফরহাদকে মূর্মুষ অবস্থায় তার দেহ কুকুর বিড়ালে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে। এই সেই কক্সবাজার, যেখানে অ্যাডভোকেট পীযুষ চৌধুরীর শ্রদ্ধেয় পিতা অ্যাডভোকেট জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরীকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

তাদেরই প্রাণের বিনিময়ে, তাজা রক্তের বিনিময়ে, পাক হানাদারবাহিনীর দখলমুক্ত আজকে আমাদের কক্সবাজার, বাঙালিদের কক্সবাজার। সমগ্র বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে আমি এই বীর শহীদ ও দেশপ্রেমিক মানুষের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং মহান আল্লাহর কাছে তাদের জন্য দোয়া ও মাগফেরাত প্রার্থনা করছি।

কক্সবাজার,শত্রুমুক্ত,ডিসেম্বর
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত