
দীর্ঘ এক দশকের ভোগান্তি ও জটিলতা পেরিয়ে সিজিপিএ ৪.০০ পেয়ে মাস্টার্সের ফলাফল পেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম। বুধবার (২৬ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রিভিউ শেষে তার মাস্টার্সের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রফিকুল ২০০৭-২০০৮ সেশনে ফলিত গণিত বিভাগে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষেই তিনি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন।
পরের বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করে। তারপর থেকেই শুরু হয় বিরোধীদের দমন-পীড়ন। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবে তাকে ‘শিবির ট্যাগ’ দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় এবং কারাগারে পাঠানো হয়। তবে জেল থেকেই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আবারও প্রথম হন তিনি। অনার্সে ৩.৮০ সিজিপিএ পেয়ে ১ম স্থান লাভ করেন এবং অর্জন করেন গোল্ড মেডেল।
২০১৪ সালে বিভাগে ২ জন প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে রফিকুল এপিয়ার্ড সনদ দিয়ে আবেদন করেন। এরপরই শুরু হয় নতুন জটিলতা। একই বছর বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর শামসুল আলম সরকারের বিরুদ্ধে ‘নম্বরপত্র টেম্পারিং’-এর অভিযোগ তোলা হয়, যার সঙ্গে রফিকুলকেও জড়ানো হয়। যদিও পরবর্তীতে তদন্তে এর সত্যতা মেলেনি।
পরে বিভাগের আরেক শিক্ষক প্রফেসর আশরাফুজ্জামান খান আকাশ তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহম্মদ মিজানউদ্দিনের কাছে রফিকুলের ব্যাপারে থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ করেন এবং বিভাগের কিছু শিক্ষার্থীকে দিয়ে মানববন্ধনও করান—এমনটাও শোনা যায়। রাজনৈতিক চাপ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ফলে শেষ পর্যন্ত সুপারভাইজার কর্তৃক থিসিস জালিয়াতির ভিত্তিহীন অভিযোগে রফিকুলের ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের ৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীবের কাছে রেজিস্ট্রেশন পুনর্বহালের আবেদন করেন রফিকুল। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রিভিউ কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাঁর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিয়ে সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।
চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩৬তম সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি সিন্ডিকেটে রিভিউ কমিটি গঠন করে। কমিটি যাচাই করে থিসিস পুনঃসংশোধনের নির্দেশ দেয়। সংশোধিত থিসিস মূল্যায়নের পর আজ তাঁর ফল প্রকাশ করা হয়।
ফল প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় রফিকুল ইসলাম বলেন, “২০১৫ সালে আমার ছাত্রত্ব বাতিলের পর প্রায়ই দোয়া করতাম, আল্লাহ আমার মৃত্যুর পূর্বে হলেও আমার প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিও, আমার মায়ের জীবদ্দশায় তাঁর চোখের পানির প্রতিদান দিও। মহান রব আমার দোয়া কবুল করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। এ সম্মান ফিরে পেতে অনেকের ত্যাগ রয়েছে, আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।”
তিনি আরও বলেন, একজন সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নষ্ট করার পেছনে যেসব শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জড়িত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে রাকসুর ভিপি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, “রফিকুল ইসলাম ভাই রাজশাহী মহানগর ছাত্রশিবিরের সাবেক শিক্ষা সম্পাদক ছিলেন। ভাইটির ওপর করা ফ্যাসিবাদী জুলুমের যুগাবসান ঘটল আজকে। জেলে থেকে পরীক্ষা, অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, মাস্টার্সেও ৪.০০ পেয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট—এত ভালো ফলাফল। তাই জেলে ভরেও শান্তি হলো না, আটকে রাখা হলো ফলাফল। একদিন-দুদিন নয়, দীর্ঘ ১২ বছর পর আজ ফলাফল পেলেন।”
তিনি আরও বলেন, “এভাবে ছাত্রশিবিরের কত ভাই যে শুধু একাডেমিক হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছে—তার ইয়ত্তা নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে গেছে, কিন্তু সার্টিফিকেট উঠাতে দেয়নি—এমন ভাইয়ের সংখ্যা ভুরি ভুরি। ছাত্রশিবিরের ত্যাগ–তিতিক্ষার শেকড় এই ক্যাম্পাসে অনেক গভীর। আমাদের বিজয় তাদের স্যাক্রিফাইসের ওপর দাঁড়িয়ে।”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা আমিরুল ইসলাম বলেন, “এর মাধ্যমে তারা শুধু ছেলেটির রেজাল্টই নষ্ট করেনি, তাঁর জীবনের ছন্দও নষ্ট হয়েছে। সেজন্য যে বিচার তিনি চান—আমার ধারণা, তিনি ন্যায়বিচার পাবেন।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মাঈন উদ্দীন বলেন, “তার উপর সত্যিই জুলুম করা হয়েছে। তার রেজাল্টের জন্য একটি পরীক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির অধীনেই আজকের এই রেজাল্ট প্রকাশিত হয়েছে। যারা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছিল—ওই ৫ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়েছে। তাদেরকে চেয়ারম্যান পদ বাতিলসহ অ্যাকাডেমিক কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে।”