ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইমাম মাহদির পরিচয় ও আগমনের আলামত

ইমাম মাহদি রাজত্বের শেষদিকে মুসলিমদের নিয়ে মসজিদুল আকসায় আশ্রয় নেবেন। বাইরে দাজ্জাল ইহুদিদের নিয়ে তাদের হত্যা করার জন্য বন্দি করে রাখবে। অন্যদিকে মুসলিমরাও দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে। এরই মধ্যে ইসা (আ.) দামেস্কে আগমন করে মুমিনদের রক্ষা করতে ফিলিস্তিনে রওনা হবেন
ইমাম মাহদির পরিচয় ও আগমনের আলামত

পৃথিবীতে কেয়ামত হবে- এটি চিরন্তন অবিচল সত্য। কিন্তু কখন হবে, আল্লাহ ভালো জানেন। এ ব্যাপারে কাউকে কিছু জানানো হয়নি। এমনকি নবী-রাসুল বা ফেরেশতাদেরও। তবে কোরআন ও হাদিসে কেয়ামতের আগের বেশ কিছু আলামতের কথা এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ইমাম মাহদির আগমন।

ইমাম মাহদির পরিচয় : ইমাম মাহদির নাম মুহাম্মাদ। বাবার নাম আবদুল্লাহ। প্রায় হাদিসে তার নাম মাহদি এসেছে। মুসলমানরা মাহদি নামেই তাকে বেশি জানে। মাহদি অর্থ ন্যায়নিষ্ঠ, সুপথপ্রাপ্ত, প্রতিশ্রুত। পৃথিবীতে এসে তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন। শান্তির হাওয়া বয়ে দেবেন। দূর করবেন অন্যায় ও জুলুমের খড়্গ।

ইমাম মাহদি নবীজি (সা.)-এর বংশধর। বাবার দিক থেকে হাসানের (রা.) এবং মায়ের দিক দিয়ে হুসাইনের (রা.) বংশধর হবেন। উম্মে সালামা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, মাহদি অমার পরিজন থেকে ফাতেমার সন্তানদের বংশ থেকে আবির্ভূত হবে।’ (আবু দাউদ : ৪২৮৪)। ইমাম মাহদি নবী নন। তবে তিনি হবেন মুসলমানদের নেতা। ইসা (আ.) তার ইমামতিতে নামাজ আদায় করবেন।

কত সালে কোথায় আগমন করবেন ইমাম মাহদি? : ইমাম মাহদি কত সালে জন্মগ্রহণ করবেন, পৃথিবীতে এসেছেন কি না, এ ব্যাপারে কোরআন-হাদিসে সুস্পষ্ট কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। হাদিসের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, তিনি কেয়ামতের আগে পৃথিবীতে আগমন করবেন। তিনি কোন শহরে জন্মগ্রহণ করবেন, এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কানজুল উম্মাল বইয়ে আছে, তার জন্ম হবে মদিনায়। (কানজুল উম্মাল : ৩৯৬৭১)। ইবনে উমর (রা.) মনে করেন, ইমাম মাহদির জন্মশহর কুফায়। তিনি কুফাবাসীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে কুফাবাসী, তোমরা ইমাম মাহদির আগমনে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৩৩১২১)।

অনেক ইসলামি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইমাম মাহদি মদিনা থেকে আত্মপ্রকাশ করবেন। সেখান থেকে মক্কায় আসবেন। মক্কায় কিছু মানুষ তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবেন। তৎকালীন সময়ে আরবের জালেমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি জয়ী হবেন। তিনি হবেন মুসলিমদের নেতা।

দেখতে কেমন হবেন তিনি : ইমাম মাহদি দেখতে কেমন হবে, এ সম্পর্কে হাদিসে আলোচনা আছে। ইমাম মাহদি হবেন মধ্যম প্রকৃতির। গঠন গড়ন হবে খুবই সুন্দর। কপাল হবে দীপ্তিময় ও প্রশস্ত। ডাগর ডাগর চোখ হবে। নাক হবে সরু, লম্বা ও খাঁড়া। চেহারা হবে উজ্জ্বল তারকার মতো। তার ডান গালে একটা তিল থাকবে। আবু সাইদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মাহদি আমার বংশধর। উজ্জ্বল ললাট ও নত নাসিকা বিশিষ্ট। (অর্থাৎ দীর্ঘ নাক তথা অগ্রভাগ কিছুটা সরু এবং মধ্যভাগ কিছুটা স্ফীত, একেবারে চ্যাপটে নয়) ন্যায় ও নিষ্ঠায় পৃথিবী ভরে দেবে, ঠিক যেমন এর আগে অত্যাচার-অবিচারে ভরে গিয়েছিল। সাত বছর রাজত্ব করবে।’ (আবু দাউদ : ৪২৮৫)।

ইমাম মাহদি আগমনের আলামত : তখন পৃথিবীর দিকে দিকে অন্যায়-অবিচার বেড়ে যাবে। মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হবে। জুলুম করা হবে। সবখানে চলবে দুঃশাসন। সত্যের ওপর প্রাধান্য পাবে মিথ্যা। ধর্মের ওপর বিস্তার লাভ করবে অধর্ম। ন্যায়কে পদধূলিত করবে অন্যায়। নারী ও দুর্বলের জন্য পৃথিবী হয়ে উঠবে ভয়ংকর জায়গা। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নিয়মে চলবে দেশ। পাপাচার ও ব্যভিচারে সয়লাভ করবে পৃথিবীর অলি-গলি ও পাড়া-মহল্লা। হত্যা, লুটতরাজ ও যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়বে বড় বড় জাতি ও দেশ। সেসময় পৃথিবীতে ন্যায় ও নিষ্ঠার মশাল নিয়ে আগমন করবেন ইমাম মাহদি।

বরকত নেমে আসবে পৃথিবীতে : ইমাম মাহদি শেষ সময়ে পৃথিবীতে আসবেন। তার আগমনে উম্মতে মুহাম্মদির সম্মান বাড়বে। তার শাসনামলে আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টি নামবে। জমিনে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হবে। গৃহপালিত পশুর সংখ্যা বাড়বে। তিনি মানুষের মাঝে সমানভাবে সম্পদ বিতরণ করবেন। (সিলসিলায়ে সহিহা : ৭১১)।

নিরাপরাধ লোকদের হত্যা : অন্ধকারের অতল গহ্বরে ঢেকে যাবে পৃথিবী। হত্যা করা হবে নিরাপরাধ মানুষকে। হত্যা ও জুলুমের ফেতনা ছড়িয়ে পড়বে দেশ-দেশান্তরে। সত্য উচ্চারণের খুব বেশি মানুষ পৃথিবীতে পাওয়া যাবে না। ঠিক তখনই পৃথিবীতে আসবেন ইমাম মাহদি। ইবনে হাজার হাইতামি (রহ.) বলেন, ‘নিরপরাধ লোকদের একটি বড় অংশকে হত্যা করে ফেলার পর ইমাম মাহদির আগমন ঘটবে। হত্যার ফেতনা থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না। দ্রুততার সঙ্গে এ ফেতনা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে। একসময় আসমান-জমিনের মাঝে এ ধরনের হত্যাযজ্ঞের ধারা বন্ধ হলে ইমাম মাহদির আগমন হবে।’ (আল-কওলুল মুখতাসার ফি আলামাতিল মাহদিল মুনতাজার : ২১-২২ ও ৩৭)।

এক তৃতীয়াংশ মানুষ বেঁচে থাকবে : ইমাম মাহদি আগমনের সময় পৃথিবীতে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বেঁচে থাকবে। আলি (রা.) বলেন, ‘ইমাম মাহদির আগমনের আগে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে হত্যা করা হবে। এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যাবে। আর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ অবশিষ্ট থাকবে।’ (কিতাবুল ফিতান, নুআইম বিন হাম্মাদ : ৯৫৯)।

কিয়ামতের আগে আগমন করবেন : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পৃথিবীর জীবনসায়াহ্নে যদি একটি মাত্র দিন অবশিষ্ট থাকে, তবে সে দিনটিকে আল্লাহতায়ালা দীর্ঘ করে আমার পরিবারস্ত একজন ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন। তার নাম আমার নাম এবং তার পিতার নাম আমার পিতার নামের মতো হবে।’ (তিরমিজি : ২২৩০)।

ইসা (আ.) ও তখন পৃথিবীতে আসবেন : ইমাম মাহদির সময় পৃথিবীতে ইসা (আ.)-এর আগমন হবে। তিনি ইমাম মাহদির পেছনে ফজরের নামাজ আদায় করবেন। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেমন হবে যখন তোমাদের মাঝে মরিয়মের ছেলে ইসা (আ.) অবতরণ করে তোমাদেরই একজনের পেছনে ফজরের নামাজ আদায় করবেন।’ (মুসলিম : ৪০৯)। ইসলামি বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইমাম হবেন ইমাম মাহদি।

ফিলিস্তিন এবং ইমাম মাহদি : ইমাম মাহদি রাজত্বের শেষদিকে মুসলিমদের নিয়ে মসজিদুল আকসায় আশ্রয় নেবেন। বাইরে দাজ্জাল ইহুদিদের নিয়ে তাদের হত্যা করার জন্য বন্দি করে রাখবে। অন্যদিকে মুসলিমরাও দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে। এরই মধ্যে ইসা (আ.) দামেস্কে আগমন করে মুমিনদের রক্ষা করতে ফিলিস্তিনে রওনা হবেন। (তিরমিজি : ২২৪০)।

ইমাম মাহদিকে মেনে নিতে নবীজির (সা.) নির্দেশনা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের রত্ন-ভান্ডারের (কাবার) কাছে তিনজন খলিফার সন্তান যুদ্ধ করতে থাকবে। কেউই দখলে সফল হবে না। প্রাচ্য থেকে একদল কালো পতাকাবাহী লোক এসে (তোমাদের কাছে) নেতৃত্ব চাইবে; কিন্তু তখনকার নেতৃস্থানীয়রা তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করবে। ফলে তারা যুদ্ধ করবে। যুদ্ধে তাদের (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সাহায্য করা হবে। তারা তোমাদের এমনভাবে হত্যা করবে, যেমনটি এর আগে কেউ (কখনো) করেনি। অতএব, তারা বিজয়ী হবে। অতঃপর তাদের নেতৃত্ব দেওয়া হবে; কিন্তু এবার তারা তা গ্রহণ না করে আমার পরিবারস্ত এক লোকের হাতে সোপর্দ করে দেবে। যে জমিনকে ন্যায়-ইনসাফে ভরে দেবে। ঠিক যেমনভাবে এর আগে জুলুম অত্যাচারে ভরে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং তোমাদের মধ্যে উপস্থিতরা তার কাছে বাইয়াত হয়ে যায়। যদিও তোমাদের এমনটি করতে হামাগুড়ি দিয়ে বরফের পাহাড় পাড়ি দিতে হয়।’ (ইবনে মাজাহ : ৪০৮৪; আল-বাজজার, আল-বাহরুজ জাখখার, ১০/১০০)।

দাজ্জালকে হত্যায় সহযোগিতা করবেন মাহদি : সুনানে আবু দাউদের ভাষ্যকার আল্লামা শামছুল হক আজিমাবাদি বলেন, ‘শেষ যুগে এক সৎ লোক আগমন করে ইসলামকে শক্তিশালী করবেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। মুসলমানরা তার অনুসরণ করবে। সমস্ত ইসলামি রাজ্যের ওপর তার আধিপত্য বিস্তার হবে। তার নাম হবে মাহদি। তার আগমণের পরেই সহিহ হাদিসে বর্ণিত কেয়ামতের অন্যান্য বড় আলামতগুলো প্রকাশিত হবে। তার সময়েই ইসা (আ.) আগমণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। এ ব্যাপারে মাহদিও তাকে সহযোগিতা করবেন।

তিনি কত বছর রাজত্ব করবেন? : ইমাম মাহদি কত বছর রাজত্ব করবেন এ নিয়ে ইসলামি স্কলারদের মাঝে মতভেদ আছে। সিলসিলায়ে সহিহার ৭১১ নম্বর হাদিসে আছে, তিনি সাত বা আট বছর রাজত্ব করবেন। কাতাদাহ (রহ.) বলেন, ‘তিনি ৯ বছর অবস্থান করবেন। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) বলেন, ‘মুআজ ছাড়া অন্যরা হিশাম থেকে বর্ণনা করে বলেন, ৯ বছর অবস্থান করবেন।’ (আবু দাউদ : ৪২৮৭)।

লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

ইমাম মাহদি,পরিচয়,আগমনের আলামত,দাজ্জাল,কিয়ামতের আলামত
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত